ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে নোয়াখালী গণহত্যা। আজ প্রথম পর্ব।
ভূমিকাঃ
“নোয়াখালির ধ্বংসকান্ড” সম্বন্ধে আলোচনা প্রকাশিত হইতে হইতে তৎকালীন বাঙলা গভর্ণমেন্টের আদেশের ফলে অপ্রত্যাশিতভাবে উহার প্রকাশ বন্ধ হইয়া যায়। ১৯৪৭ সালের ৩০শে মে তারিখে মিঃ সুরাবর্দীর পরিচালিত বাঙলা গভর্ণমেন্ট নোয়াখালির ধ্বংসকাণ্ড সম্বন্ধে প্রবন্ধ প্রকাশের অপরাধে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ও ‘হিন্দুস্থান ষ্ট্যাণ্ডার্ডের’ কয়েকটি সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করেন এবং উভয় সংবাদপত্রের ৭০০০ টাকা জামানত বাজেয়াপ্ত করিয়া পুনরায় ১৭০০০ টাকা নূতন জামানত আদায় করেন। ফলে, প্রবন্ধ প্রকাশ এবং প্রবন্ধসমূহের পুস্তকাকারে প্রকাশ বন্ধ হয়। বৰ্ত্তমান বংসরের জানুয়ারী মাসে ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের পরিচালিত পশ্চিম বাঙলা গভর্ণমেন্ট এক আদেশ জারী করিয়া ( আঃ বাঃ পত্রিকা ২০/১/৪৮) পূৰ্ব্ব গভর্ণমেন্টের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। তাহার ফলেই বর্তমান গ্রন্থের প্রকাশ সম্ভব হইয়াছে। নোয়াখালি-সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ-প্রকাশ যখন তৎকালীন গভর্ণমেন্টের আদেশের ফলে বন্ধ হইয়া যায় তখন হইতে পুনঃ পুনঃ এই চিন্তাই মনে উঠিয়াছে, বর্তমানকালের বাঙলাদেশে যে এইরূপ ব্যাপার ঘটা সম্ভব হইয়াছিল ভবিষ্যৎকালের জন্য তাহার কিছু একটা ইতিহাস রক্ষিত হওয়া উচিত। সে চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা এতদিনে ফলবতী হইয়াছে। যে সকল প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল এবং সরকারী আদেশের ফলে যাহা প্রকাশিত হইতে পারে নাই সমস্তই এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হইল। প্রবন্ধ গুলি যাহাতে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় তজ্জন্য, প্রবন্ধ-প্রকাশের সময় হইতে আরম্ভ করিয়া এ পর্যন্ত, বাঙলাদেশ হইতে এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান হইতে বহু অনুরোধপত্র পাইয়াছি; সাক্ষাৎভাবেও অনেকে ইহার জন্য আগ্রহ জানাইয়াছেন। কিন্তু এত অনুরোধ ও আগ্রহ সত্ত্বেও গ্রন্থ প্রকাশ করিতে পারি নাই, কারণ উহা সম্ভব ছিল না। আজ গ্রন্থ-প্রকাশের প্রাক্কালে তাহাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাইতেছি।
যে প্রেরণা লইয়া নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনাসমূহের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম গ্রন্থ প্রকাশের প্রেরণা তাহা হইতে স্বতন্ত্র। অপ্রত্যাশিত ও কল্পনাতীত ভয়াবহ বর্বর ঘটনা মনকে রূঢ়ভাবে আঘাত করিয়া সদ্য সদ্য যে চেতনা ও চিন্তা জাগাইয়াছিল আলোচনার মধ্যে প্রকাশ পাইয়াছিল তাহাই। কিন্তু গ্রন্থপ্রকাশের প্রেরণা ঐতিহাসিক। নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনা সাম্প্রদায়িক অগ্ন্যুৎপাতের আকারে দেখা দিয়াছিল বটে কিন্তু এখন উহা ইতিহাসের পৰ্যায়ভুক্ত হইয়া গিয়াছে। ঘটনার পর আজ প্রায় দুই বৎসর হইতে চলিল। ঘটনার সমকালে যে দৃষ্টি ও মনোভাব লইয়া লোকে উহা দেখিয়াছিল এবং জনসমাজে উহা যে মনোভাবের সৃষ্টি করিয়াছিল এখন আর তাহা বৰ্ত্তমান নাই। এখন ইতিহাসের দৃষ্টি ও মনোভাব লইয়াই লোকে উহা দেখিবে ও পর্যালোচনা করিবে। উহাকে এখন আর কেহ মাত্র সাম্প্রদায়িক কাণ্ড বলিয়া সীমাবদ্ধ করিয়া দেখে না। পরবর্তী কালের ঘটনাসমূহের বৃহত্তর পটভূমিকায় উহা এখন সমসাময়িক ইতিহাসের অঙ্গ ও অংশ হইয়া গিয়াছে।
মুক্তিসাধনা ও গৃহযুদ্ধঃ
সে ইতিহাস কি এবং কিসের? পরাধীন জাতির মুক্তিসাধনার জন্য, স্বৈরাচারী শাসকের কবল হইতে জনগণের মুক্তি অর্জনের জন্য যে সকল স্তরের মধ্য দিয়া যাইতে হয় তাহাতে Civil War বা গৃহযুদ্ধ অধিকাংশ স্থলেই কোন না কোন পর্যায়ে দেখা দিয়া থাকে। নিতান্ত সৌভাগ্য না হইলে কোন দেশ ইহা হইতে অব্যাহতি পায় না। অন্যান্য প্রায় সকল দেশেই ইহা ঘটিয়াছে এবং আমাদের দেশেও ইহার ব্যতিক্রম হইল না। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র সম্বন্ধে ইতিহাস যে সাক্ষ্য বহন করিতেছে ভারতবর্ষকে তাহা হইতে মুক্ত রাখিবার জন্য মহাত্মাজী প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং অত্যন্ত দূরপ্রসারী দৃষ্টি লইয়া দেশের রাজনৈতিক মুক্তিসাধনার জন্য অহিংস আন্দোলনের প্রবর্তন করিয়াছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পথে গৃহযুদ্ধ আসিয়া পড়িবে বলিয়া মহাত্মাজীর আশঙ্কা ছিল। সেইজন্যই রাজনীতিক্ষেত্রে আমাদিগকে অহিংসায় দৃঢ় রাখিবার জন্য তিনি এত চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমরা উহাকে সীমাবদ্ধ অর্থে গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং বৈদেশিক প্রভুশক্তির সহিত আমাদের সংঘর্ষ অহিংস-নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করিয়াই ক্ষান্ত ছিলাম। যে দূরতর দৃষ্টি লইয়া মহত্মাজী উহা প্রবর্তন করিয়াছিলেন তৎসম্বন্ধে ভারতবর্ষের জনসমাজ যদি অবহিত হইত এবং রাজনীতিতে পরস্পরের সহিত সম্বন্ধ মহাত্মাজীর নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইত তাহা হইলে গৃহযুদ্ধের ভীষণতা হইতে আমরা অব্যাহতি পাইতাম। কিন্তু তাহা হয় নাই, পরস্পরের সহিত সম্বন্ধ আমরা মহাত্মাজীর নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করিতে পারি নাই। ফলে, অতীতে অন্য দেশে যাহা ঘটিয়াছে এবং বর্তমানে আমাদের চক্ষের উপর অন্যান্য দেশে যাহা ঘটিতেছে আমাদের দেশেও ঘটিয়াছে তাহাই। তবে আমাদের দেশের রাজনীতির পূর্বাপর ধারা ও আমাদের জীবনের পারিপার্শ্বিক আবেষ্টনের প্রভাবে ইহা এক বিশেষ প্রকারের রূপ ও গতি লইয়াছে। Civil War বা গৃহযুদ্ধ মুক্তি আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া। স্বাধীনতালাভ-প্রয়াসের প্রতিরোধমুখেই গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়া থাকে। সুতরাং ইহা রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষরূপেই দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতে উহার প্রাদুর্ভাব হইয়াছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আকারে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগতি প্রতিহত ও প্রতিরুদ্ধ করিবার জন্য ব্রিটিশ কূটবুদ্ধি সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির প্রবর্তন করিয়াছিল। এই সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির ক্রিয়াই ফুলে ফলে পল্লবিত হইয়া পরস্পরের মধ্যে অবিশ্বাস, তিক্ততা ও সংঘর্ষ আনিয়াছে এবং শেষ পর্যন্ত দেশখণ্ডন ও লোক-বিনিময় পর্যন্ত ঘটাইয়াছে। ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ হইতে মুক্তিলাভের প্রয়াসী ভারতবর্ষে গৃহযুদ্ধ এই পথে ও এই আকারেই দেখা দিয়াছে। মাত্র সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ বলিয়া যাহাকে সীমাবদ্ধ করিয়া আমরা দেখিতে চাহিয়াছি তাহা যে স্বরূপতঃ রাজনৈতিক সংঘর্ষ তাহা ক্রমশঃ অভিব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে এবং গৃহযুদ্ধের রূপ গ্রহণ করিয়াছে। যে স্থলে মানসিক দুৰ্বলতাবশতঃ আমরা ভুল করিয়াছিলাম এবং এই সংঘর্ষের স্বরূপ লক্ষ্য করিতে ও স্বরূপে ইহাকে উপলব্ধি করিতে পরাঙ্মুখ হইয়াছিলাম ইতিহাস সে স্থলে ভুল করে নাই, ইতিহাস পরাঙ্মুখ হয় নাই ; বীজ হইতে বৃক্ষ ও তাহার পরবর্তী পরিণতি প্রকৃতির অপরিহার্য নিয়মেই ঘটিয়া উঠিয়াছে। সেইজন্য নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনা মাত্র সাম্প্রদায়িক ব্যাপার নহে, প্রত্যুত উহা মুক্তি আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াস্বরূপে সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও ইতিহাসের অঙ্গ।
মুসলীম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামঃ
কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ও ভারত গভর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে মুসলীম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের’ [মুসলীম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের’ প্রস্তাব এখন সর্বত্র কুখ্যাত। ইহা ১৯৪৬ সালের ২৯শে জুলাই বোম্বাই সহরে নিখিল ভারত মুসলীম লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবদ্বয়ের অন্যতম। ভারতীয় শাসনপদ্ধতি সম্বন্ধে ব্রিটিশ মন্ত্রীমিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে লীগ কাউন্সিল পূর্বে সম্মত হইয়াছিল। উল্লিখিত প্রস্তাবদ্বয়ের প্রথমটির দ্বারা সেই সম্মতি প্রত্যাহার করা হয় এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবে মুসলীম লীগের দাবী পূরণের উদ্দেশ্যে চাপ দিবার জন্য প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ চালাইবার সংকল্প গ্রহণ করা হয়।] আন্দোলনেই এই গৃহযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি। ১৯৪৬ সালের আগষ্ট মাসে কলিকাতায় যাহা ঘটে তাহাকেই এই চূড়ান্ত অবস্থার প্রথম পৰ্য্যায় বলা যাইতে পারে কিন্তু নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনাতেই ইহার স্বরূপ প্রকাশ। নোয়াখালির পর ঘটনার ধারা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আরও অগ্রসর হইয়াছে। বিহার, যুক্ত প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ এবং সর্বশেষ ও সর্বচূড়ান্ত পাঞ্জাব—এই কয়টি প্রদেশে পর পর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও প্রত্যাক্রমণের রূপে যাহা ঘটিয়াছে সেগুলিও এই একই ঐতিহাসিক পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ এগুলিও ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালবর্তী Civil War বা গৃহযুদ্ধের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাক্ষেত্র। ভারতের পূৰ্ব্বসীমায় নোয়াখালিতে যে অভিযানের প্রারম্ভ দেখা দিয়াছিল পশ্চিম সীমায় পাঞ্জাবে তাহাই বৃহত্তম আকারে ঘটিয়াছে এবং এখনও পাকিস্থানী হানাদারদিগের আক্রমণে কাশ্মীরে সংঘটিত হইতেছে। পাঞ্জাবে ইহার সূত্রপাত হইয়াছে বিভাগের পূর্বে ; এবং বিভাগ হইবার পর পর্যন্ত পাঞ্জাবের পূর্ব ও পশ্চিম খণ্ডে মিলিয়া যাহা ঘটিয়াছে তাহা সকল কল্পনাকে ছাড়াইয়া গিয়াছে। সমগ্র পশ্চিম পাকিস্থান অর্থাৎ পশ্চিম পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু হইতে হিন্দুর বাসের প্রায় সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটিয়াছে এবং পূর্ব পাঞ্জাব হইতে মুসলমানের বাস উৎসন্ন হইয়াছে। পাঞ্জাবের দুই দিকে মিলিয়া মোট এক কোটি লোক উদ্বাস্তু ও স্থানচ্যুত হইয়াছে। ইহা মাত্র সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ফল নহে। একটা বৃহৎ যুদ্ধেও সাধারণতঃ এই বিপুল সংখ্যক লোকের উচ্ছেদ ঘটে না। বিগত যুদ্ধে মধ্য ইউরোপ হইতে যে জনসমষ্টি উৎখাত হইয়াছে তাহাদের সংখ্যা উভয় পাঞ্জাবের মিলিত জনসংখ্যা হইতে অনেক কম। নোয়াখালির ঘটনা দেখিয়াও যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে আমরা ইতস্ততঃ করিয়াছিলাম পাঞ্জাবের ঘটনা সে ক্ষেত্রে আমাদের কোন সঙ্কোচ বা সংশয়ের অবসর রাখে নাই। আমরা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছি যে ঐতিহাসিক স্বরূপে এবং ইতিহাসের বিচারে ইহা গৃহযুদ্ধরূপেই গণ্য। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় ও প্রতিরোধে গৃহযুদ্ধ বাধাইবার প্রবৃত্তি ব্রিটিশ-অনুগ্রহ-পুষ্ট মুসলীম লীগের দিক হইতেই দেখা দিয়াছিল। ব্রিটিশের প্রসাদে রাজ্যখণ্ডের অধিকারী হইয়া এই গৃহযুদ্ধকে তাহারা অভীপ্সিত শেষ পরিণতির দিকে লইয়া গিয়াছে। পশ্চিম পাকিস্থান হিন্দুশূন্য হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্থান হইতে হিন্দুদিগের ব্যাপক বাস্তুত্যাগ আরম্ভ হইয়াছে, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। নোয়াখালির ঘটনা দেখিয়া প্রথমেই বলিয়াছিলাম ইহা সাম্প্রদায়িক ব্যাপার নহে— “It is a total war on minority”— ইহা মাইনরিটিকে সমূলে উচ্ছেদ করিবারই প্রয়াস। এতদিনে তাহা সম্পূর্ণ সত্যকার রূপে প্রকট হইয়াছে।
বিবরন অসম্পূর্ণঃ
নোয়াখালিতে যাহা ঘটিয়াছে তাহার সম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয় নাই, প্রকাশ করিবার উপায় ছিল না। সংবাদপত্রের অফিসে অফিসে বহু বিবরণ আসিয়া স্তুপীকৃত হইয়াছে যাহার এক ভগ্নাংশও প্রকাশত হইতে পারে নাই। তৎকালীন গভর্ণমেন্ট বিশেষ নিয়ন্ত্ৰণাদেশ জারী করিয়া উহার প্রকাশ বন্ধ করিয়া ছলেন। লুণ্ঠন, গৃহদাহ, ধৰ্মনাশ, হত্যা ও নারীহরণ-নোয়াখালি-ত্রিপুরায় এই পঞ্চাঙ্গ অভিযানের প্রথম দুইটির বিবরণ মোটামুটি বোঝা গিয়াছে এবং দ্বিতীয়টির বিবরণও অনেকটা জানা গিয়াছে, কিন্তু যে দুইটার সম্পূর্ণ বিবরণ জানিবার বিশেষ। প্রয়োজন ছিল, কিন্তু জানা গেল না এবং এখন আর জানিবার উপায় নাই তাহা হইল হত্যা ও নারীহরণ। হত্যার বিবরণ যদিও খানিকটা সংগ্রহ করা যায় নারীহরণের বিবরণ পাইবার সম্ভাবনা আরও কম। কারণ, পরিবারসমূহ বিধ্বস্ত ও বিক্ষিপ্ত, অপহৃতাগণ অপসারিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী। আপনারাই উহা গোপন করিবার জন্য উদ্বিগ্ন। যে সকল বিবরণ পাওয়া গিয়াছে এবং ঘটনাস্থলে যাহা দেখা গিয়াছে তাহা হইতে খানিকটা অনুমান করিয়া লওয়া যায়। এই দুইটা বিষয় লইয়া যাহারা সংখ্যাগত হিসাব করিতে চাহিবেন তাহারা কখনও বলিতে পারিবেন না যে — “ইহার অধিক হয় নাই; তাহারা বড় জোর বলিতে পারেন যে “এই পৰ্য্যন্ত হিসাব পাওয়া গিয়াছে বা নির্ধারিত হইয়াছে।”
যে সরকারী নিষেধাজ্ঞার ফলে নোয়াখালি-ত্রিপুরার উপদ্রব সম্বন্ধীয় সংবাদ প্রকাশে বাধার সৃষ্টি হয় তাহাতে প্রথমে বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটিকে [এই কমিটি নিখিল ভারতীয় সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলনের প্রাদেশিক মুখপাত্র এবং কলিকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকদিগকে লইয়া গঠিত।] একটু বিশেষ সুযোগ দেওয়া হইয়াছিল। বলা হইয়াছিল, প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটি যে সকল সংবাদ ও বিবরণের প্রকাশ অনুমোদন করিবেন তাহা নিষেধাজ্ঞার আমলে পড়িবে না। বহু প্রয়াসের পর কমিটি মিঃ সুরাবর্দীর নিকট হইতে এইটুকু অধিকার আদায় করিতে সমর্থ হইয়াছিল। কিন্তু কমিটির কার্যের ফলে নিষেধাজ্ঞার বিধানসমূহ উল্লখিত হইতেছে এবং উহার উদ্দেশ্য পণ্ড হইতেছে এই অভিযোগ করিয়া পরে গভর্ণমেন্ট এই সুযোগ নাকচ করিয়া দেন; তবে যতটুকু কাল ইহা বর্তমান ছিল তাহারই মধ্যে প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির অনুমোদনে নোয়াখালি-ত্রিপুরার ঘটনা কিছু প্রকাশিত হইতে পারিয়াছিল। প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটি না থাকিলে তাহাও প্রকাশ হইত না। এই কমিটির কর্মপরিচালনার সূত্রে এমন বহু সংবাদ ও বিবরণ পাইয়াছিলাম যাহা কমিটির পক্ষেও প্রকাশ করিতে দেওয়া সম্ভব ছিল না ; ‘আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক হিসাবেও এইরূপ বহু সংবাদ ও বিবরণ গোচরে আসিয়াছিল এবং নোয়াখালি ও ত্রিপুরায় পরিভ্রমণের সময় প্রত্যক্ষভাবেই সমস্ত শুনিবার ও দেখিবার সুযোগ ঘটিয়াছিল। পড়িয়া, শুনিয়া ও দেখিয়া যাহা জানিয়াছিলাম ও বুঝিয়াছিলাম তাহা হইতেই “নোয়াখালি-ত্রিপুরার ধ্বংসকাণ্ড” রচিত। ইহা ঘটনার আনুপূৰ্ব্বিক সংগ্রহ বা বিবরণ নহে। পূৰ্বেই বলিয়াছি ইহা ঘটনার দৃশ্য ও বর্ণনার সহিত জড়িত তৎকালীন চিন্তার প্রতিচ্ছবি। তৎকালীন অবস্থা বুঝিবার পক্ষে ইহার একটা স্বতন্ত্র উপযোগিতা আছে ; সেইজন্য, মধ্যে কিছু সময় বহিয়া গেলেও, প্রবন্ধগুলি যেভাবে প্রকাশিত হইয়াছিল গ্রন্থের মধ্যে সেই ভাবেই সন্নিবিষ্ট হইল ।**(ক্রমশ)
শ্ৰী চপলাকান্ত ভট্টাচার্য
২৬শে বৈশাখ, ১৩৫৫…
৯ই মে, ১৯৪৮, ..
কলিকাতা।
২৬শে বৈশাখ, ১৩৫৫…
৯ই মে, ১৯৪৮, ..
কলিকাতা।
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।