আমেরিকাকে বলা হয় সবচেয়ে আধুনিক একটি দেশ যেখানে সাংস্কৃতিক ঐতির্য্য সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং পোশাক পরিচ্ছেদ অনেক বেশি খোলা মেলা। জীবনের সব পরতে সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া। টেকনোলজি থেকে শুরু করে সামরিক সব দিক থেকে তারা বিশ্বের যে কোন দেশ থেকে এগিয়ে। সেখানে বৈদিক সিটি ? বৈদিক শব্দটা বলতেই যে মনে চলে আসে হাজার হাজার বছর পিছনে ফিরে যাওয়া, মরিচা পড়া এক সমাজের কথা। কিন্তু এতো আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভরা এক দেশের একটি শহর হাজার হাজার বছর পিছনে ফিরে গিয়ে, মরিচা পড়া এক সমাজ ব্যবস্থায় ফিরে গেলো ? অবিশ্বাস্য হলেও সত্য আমেরিকার আইওয়া (Iowa) রাজ্যের জেফারসন কাউন্টিতে এক বৈদিক সিটির প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯৯১ সালে। এটাই হয়তো আধুনিক বিশ্বের প্রথম বৈদিক সিটি।এই শহরের নাম মহাঋষি বেদিক সিটি (Maharishi Vedic City)।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, এই সিটির আয়তন ৩.৩৬ বর্গ মাইল বা ৭.৮ বর্গ কিলোমিটার। সমগ্র আমেরিকা আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী চললেও এই শহর চলে সম্পূর্ণ বেদের আইন অনুযায়ী। এখানকার আইন প্রকৃতি প্রাপ্ত বেদের আইন যদিও আমেরিকার সংবিধানের সাথে সমতা রেখে চলা হয়। এই এলাকা ছিল পুরোটাই খাস ও কৃষি জমি। কিছু আমেরিকান ধর্মপ্রাণ হিন্দু ৩,০০০ একর (প্রায় ১২ কিলোমিটার) জায়গা কিনে নিয়ে বেদিক সিটির পরিকল্পনা করেন।গড়ে তোলা হয় বসবাসযোগ্য আধুনিক বাড়িঘর ও মন্দির বা আশ্রম। এই বৈদিক সিটি গড়তে খরচ করা হয় ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাদের হেডকোয়ার্টার বা প্রধান কার্য্যালয়ের নাম দ্যা ম্যানসন বা "The Mansion". এই হেডকোয়ার্টার বিশ্ব শান্তির (Global Country of World Peace সংক্ষেপে GCWP) জন্য কাজ করে। এই সিটির প্রধান নির্বাহীকে বলা হয় রাজা বা মেয়র। মহাঋষি বেদিক সিটি রাজা বা মেয়র হলেন বব ওয়ানে (Bob Wynne) যিনি আমেরিকা ও নিউজিলান্ডের বৈদিক সমাজের প্রধান।মোট ৫ জন কাউন্সিলার এই সিটি পরিচালনা করেন। ২০০৪ সালের হিসাব অনুযায়ী এই সিটিতে মোট ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ইনভেস্ট করা হয়।
২০০৬ সালে এখানে আরো ২০০টি নতুন বিল্ডিং তৈরী করা হয়।এখানকার বিল্ডিং গুলো তৈরী করা হয় প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক ডিজাইনে।এই ডিজাইনকে বলা হয় মহাঋষি স্থাপত্য বেদ ডিজাইন আর্কিটেকচার (Maharishi Sthapatya Veda design architecture)!এই বৈদিক ডিজাইন অধিবাসীদের জন্য সুখ, শান্তি ও সম্মৃদ্ধি বয়ে আনে বলে তারা বিশ্বাস করেন।এই বাড়িগুলোর বৈশিষ্ট হলো প্রত্যেকটা বাড়ি সূর্যের দিকে অর্থাৎ পূর্ব দিকে মুখ করে করা হয়েছে।
প্রত্যেকটা বাড়িতে একটি নিরিবিলি জায়গা আছে যাকে বলে ব্রম্মস্থান (brahmasthan), বাড়ির প্রাচীরকে বলা হয় বাস্তুবেড়া (vastu fence) এবং প্রত্যেক বাড়ির ছাদে একটি করে সোনালী কলস (kalash) আছে ।
Photo: The Maharishi Vedic Observatory Tour
সিটিতে আছে একটি বৈদিক অবজারভেটরি (Vedic Observatory) যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চন্দ্র, সূর্য ও তারার প্রকৃত মুভমেন্ট গণনা করে। ২০০২ সালে মহাঋষি বেদিক সিটি কাউন্সিল একটি নতুন আইন পাশ করে এই সিটিতে সকল ধরণের নন- অর্গানিক ফুড বা খাবার নিষিদ্ধ করে। তারা নিজেরাই নিজেদের খাবার কৃষি কাজের মাধ্যমে উৎপন্ন করে করেন এবং তাতে কোন প্রকার রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। এই অর্গানিক বা জৈবিক উপায়ে উৎপন্ন খাবার ও দুধ তারা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বাইরে বিক্রি করেন। তাদের আছে ১৬০ একর অর্গানিক ফার্ম। ২০০৩ সালে আমেরিকার সরকার মহাঋষি বেদিক সিটি কে আমেরিকার প্রথম অর্গানিক বা জৈবিক শহর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।এই সিটিতে ৫০ প্রকারের জৈবিক ফল ও সবজি উৎপাদিত হয় যা আইওয়া সিটি (Iowa City), দেস মইনেস(Des Moines), এবং শিকাগো(Chicago) সিটির বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সরবরাহ করা হয়।
অধিবাসীরা কেউ আধুনিক বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন না। এখানে সৌর বিদ্যুৎ এবং বাতাস থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে সব কাজ করা হয়।এখানে কোন স্ট্রিট লাইট নেই।
হয়তো অনেকে ভাবছেন ভারতীয়রাই ওখানে বেদিক সিটি প্রতিষ্ঠা করেছে। দেখা যাক এই শহরের জনসংখ্যা কারা।২০১৬ সালের গণনা অনুযায়ী মহাঋষি বেদিক সিটির মোট জনসংখ্যা ১,৩১০ জন। এদের মধ্যে ৯৫% আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ, ২.৩% কৃষ্ণাঙ্গ, ১.৫% এশিয়ান, এবং ১.২% অন্যান্য। বোঝাই যাচ্ছে এই বেদিক সিটি সম্পূর্ণ আমেরিকানরা প্রতিষ্ঠা করেছে।
বৈদিক জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ভারত থেকে আনা হয় ১,০০০ পন্ডিত যাদেরকে মার্কিন সরকার স্পেশাল রিলিজিয়াস ভিসা দেয়। এই ভারতীয় পন্ডিতরা শহরের অধিবাসীদের বেদের জীবন যাপন করতে সহায়তা করেন।এই ভারতীয় পন্ডিতরা অবশ্য জনসংখ্যা গণনার বাইরে।তারা অধিবাসীদের যোগ ব্যায়াম ও মেডিটেশনেও সহযোগিতা করেন।তাদের আছে নিজস্ব স্কুল, ইউনিভার্সিটি ও হোটেল। মজার ব্যাপার হচ্ছে মহাঋষি বেদিক সিটির আইডিয়াল ও অফিসিয়াল ভাষা সংস্কৃত। ইংরেজি দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা।বৈদিক জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ইংরেজির পরিবর্তে সংস্কৃতকে প্রধান অফিসিয়াল ভাষা রাখা হয়েছে। অধিবাসীদের সকলের জন্য সংস্কৃত শেখা বাধ্যতামূলক। অধিবাসীরা সম্পূর্ণ বেদের আইন ও সমাজ ব্যবস্থা জীবন ধারণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রতিবেদন। জেনে ভালো লাগলো।
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteগর্ব হয় আমেরিকানদের ধর্মের চর্চা দেখে
ReplyDelete