আর্যপ্রভা-বেদ-১
ওঁ
আর্যপ্রভা
(হিন্দুর জাতীয় সংস্কৃতির কথা)
বেদ-১
[সত্য। বেদ। অর্থবাদ। পরা শব্দ। উপনিষদ। পরা বিদ্যা, অপরাবিদ্যা। পুরুষ যজ্ঞ। অথর্ব সংহিতার কারণ। অনিত্যতার লক্ষণ। নিত্যের লক্ষণ। তদ্ভাব, Being and Becoming। তত্ত্ব। জ্ঞানকাণ্ড। শব্দ রাশি-চারবেদ। ঐতিহ্য। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ। বেদাঙ্গ। প্রাদেশিকতা। যজ্ঞ। কর্মকান্ড। সকাম সাধনার উদ্দেশ্য। নিষ্কাম সাধকের যজ্ঞ। ব্রাহ্মণের লক্ষণ। বৈদিক ব্যাকরণ। উচ্চারণ বৈকল্যে দোষ। লক্ষ্য লক্ষণ। Phonetic। আবৃত্তি নয় তত্ত্বজ্ঞান।]
ওঁ-নমস্তস্মৈ সদেকস্মৈ কস্মৈ চিন্মহসে নমঃ।
যদেতদ্বিশ্বরূপেণ রাজতে গুরু রাজ তে॥
(বিবেকচূড়ামণি ৫২১)
অর্থ- হে গুরুরাজ! সৎ স্বরূপ অদ্বিতীয় সেই ব্রহ্মকে প্রণাম এবং অনির্বচনীয় তেজঃস্বরূপ সেই ব্রহ্মকে প্রণাম, যে ব্রহ্ম এই বিশ্বরূপে আপনার সম্বন্ধে প্রকাশ পেয়েছেন।
আর্য সংস্কৃতির ইতিহাস অর্থাৎ ভারতীয় আর্য
কৃষ্টির ধারা যাতে বোঝা যায়, এমন সব কথা এবং বিশেষ করে, তন্ত্র সম্বন্ধে
ধারাবাহিক বলবার জন্য অনুরুদ্ধ হয়েছি। সাধ্যমত এ সমস্ত বিষয়, ক্রমশঃ বোঝবার
চেষ্টা করা যাবে।
সত্যকে আমরা দু-ভাবে দেখি। একটি জাগতিক সত্য-বাস্তব সত্য; এ সত্য মন বুদ্ধি
ইন্দ্রিয়ের গোচর ও তাদের উপস্থাপিত অনুমানের দ্বারা গৃহীত (বিজ্ঞান বা
science)। আর একটি অতীন্দ্রিয় সত্য- সূক্ষ্ম যোগজ শক্তির গ্রাহ্য। এই
প্রকারের সঙ্কলিত জ্ঞানকে বেদ বলা যায়। ঐ অতীন্দ্রিয় শক্তি যে পুরুষে
আবির্ভূত হন, তাঁর নাম ঋষি ও সেই শক্তির দ্বারা তিনি যে অলৌকিক সত্য
উপলব্ধি করেন, তার নাম বেদ। আর্য জাতির আবিষ্কৃত উক্ত বেদ নামক শব্দ রাশি
সম্বন্ধে এটাও বুঝতে হবে যে, তার মধ্যে যা লৌকিক অর্থবাদ বা ঐতিহ্য নয়, তাই
বেদ (স্বামীজি)। ঋগ্বেদ আদি শব্দ রাশিকে বেদ আখ্যা দেওয়া হয়। বেদ বিহিত
কর্মের স্তুতি, নিন্দা বা বিধি নিষেধ ইত্যাদিকে অর্থবাদ বলে। তন্ত্রের
ভাষায় পর(পরা) শব্দ’ই বেদ। মায়িক বা বাস্তব সত্যে, জ্ঞানে বহুত্ব রয়েছে-
পরিণাম বা পরিবর্তন আছে। যে জ্ঞানের পরিণাম হয় না, পরিবর্তন হীন যে জ্ঞান
তাই বেদ-নিত্য সত্য।
তৈত্তিরীয় আরণ্যক (১ম প্রঃ ৩য় অঃ) ও মাধ্বাচার্য্যের মতে ঐতিহ্য= স্মৃতি, ইতিহাস ও পুরাণ আদি গ্রন্থ। বেদ তত্ত্ব বা অতীন্দ্রিয় সত্য উপনিষদেই বর্তমান। ব্রহ্মবিদ্যাই পরা বিদ্যা, আর যা কিছু সমস্তই অপরা বিদ্যার অন্তর্গত; তাই উপনিষদকে বেদ শিব বলা হয়। “তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্ব্বেদঃ সামবেদোহথর্ব্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো, ব্যাকারণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি।” (মুণ্ডক-১/১/৫)। ঐ চার বেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ-অপরা বিদ্যার অন্তর্গত। একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যে পুরুষ-যজ্ঞ হতে ঋক্, যজুঃ, সাম ও ছন্দসমূহের আবির্ভাব হয় আর ঐ গুলিই অথর্ব সংহিতার কারণ। ঐ বেদ চতুষ্টয় হতে সর্বপ্রকার অপরা বিদ্যার উৎপত্তি হয়।
অনিত্যতার তিন লক্ষণ, (১) সংসর্গ নিত্যতা,
(২) পরিণাম নিত্যতা, (৩) প্রধ্বংস নিত্যতা। জবা ফুলের সংস্পর্শে কাচ লাল
দেখায়, ফুল সরিয়ে নিলে কাচের নিজরূপ প্রকাশ হয়, ফল পাকলে ফলের পূর্ব বর্ণের
পরিণতি হয়ে রঙ বদলে যায়, জিনিষ সম্পূর্ণ ধ্বংস হলে তার উপাদানগুলি
বিশ্লিষ্ট হয়ে যায়। নিত্যের দুই লক্ষণ, (১) যা ধ্রুব বা স্থির, কূটস্থ,
(কূটঃ লৌহপিণ্ডঃ ইব তিষ্ঠতি যঃ স কুটস্থ = নিত্য, নির্বিচার, উদাসীন),
অবিচালি (দেশান্তর প্রাপ্তিবিহীন-যা অন্যত্র গমন করে না), উৎপত্তিহীন,
বৃদ্ধি হীন ও অক্ষয়, (২) যার তত্ত্ব বিনষ্ট হয় না। (“ধ্রুবং
কুটস্থমবিচাল্যনপাযোপ জন বিকাৰ্য্যনুৎপত্যবৃদ্ধ্যবয় যোগী যত্তনিত্যমিতি”-
মহাভাষ্যম ১ম আঃ)। ‘তদ্ভাব্স্তত্ত্বম’, তদ্ভাবই তত্ত্ব-যার যা ধর্ম তার
নামই তত্ত্ব; আকৃতিতেও তত্ত্ব বা আকৃতিত্ব বিনষ্ট হয় না। অগ্নির দহন শক্তি
স্বতঃস্ফূর্ত। স্বতঃস্ফূর্ত সত্য বা জ্ঞানই বেদ, সর্বত্র বিরাজিত নিত্য
অস্তি (সৎ)-এই বোধের (চিৎ এর) নাম বেদ। শব্দরাশিরূপী বেদ তপস্যার ওপর জোর
দিয়েছেন- তপস্যা ভিন্ন ঐ সত্য জ্ঞান স্ফুরণ হয় না, তপস্যার স্বরূপই বেদ।
শ্রদ্ধা সম্পন্ন হৃদয়ে একাগ্র বুদ্ধি ধারণ করার অবিরত চেষ্টাই তপস্যা।
‘তদ্ভাব- তাই হওয়া ও হয়ে যাওয়া-Being and Becoming একাগ্র বুদ্ধি ভিন্ন হয়
না; সুতরাং তপস্যার ফল, সংস্কার বিমুক্ত নির্মল বুদ্ধি বা শুদ্ধ বুদ্ধি।
তত্ত্ব শুদ্ধ বুদ্ধির গোচর। মন বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ের চাপে স্বতঃস্ফূর্ত আবরিত
থাকে, তপস্যার বা সাধন দ্বারা ঐ চাপ দূর হয়ে সত্য উপলব্ধি হয়, প্রত্যক্ষ
হয়। সত্য দ্রষ্টা’ই ঋষি- মন্ত্র দ্রষ্টা। আবিষ্কার করার কিছু’ই নেই-সবই
রয়েছে, প্রয়োজন কেবল চাপ সরাবার।
ঋগ্বেদ আদি শব্দ রাশির চরম শিক্ষাই, তত্ত্বোপদেশই বা তত্ত্বই বেদের
জ্ঞানকাণ্ড বা উপনিষদ। উপনিষদ মানে, যে ব্রহ্মবিদ্যা গুরুর কাছে সমিত্পাণি
হয়ে শ্রদ্ধার সাথে শিখতে হয়। সকল আচার্যেরা উপনিষদকেই বেদ শিব বলে স্বীকার
করেছেন। আর্য কৃষ্টির মূল’ই বেদ। কোন হিন্দুই বেদ-বিরুদ্ধ কথা গ্রহণ করেন
না। তত্ত্ব জ্ঞান প্রবোধক উপাসনার কথাও উপনিষদে আছে। শব্দ রাশি বেদের
মন্ত্র ভাগই ঋগ্বেদ আদি সংহিতা ও যাতে মন্ত্র ব্যাখ্যা আছে তার নাম
ব্রাহ্মণ। উপনিষদ ঐ মন্ত্র ভাগের ও ব্রাহ্মণ ভাগের শেষে অতি সামান্য অংশ
অধিকার করে আছে বর্তমানে। মুক্তিকোপনিষদে রামচন্দ্র ১১৮০টি উপনিষদের কথা
বলে, তার মধ্যে ১০৮ উপনিষদের নাম করেছেন। কথিত আছে কলির প্রারম্ভে ১১৮০টি
উপনিষদ বর্তমান ছিল।
বেদ অপৌরুষেয়, সুতরাং অনাদি ও নিত্য। শব্দ রাশির মধ্যে ঐতিহ্য অংশ বেদ নয়, কিন্তু সব অনুষ্ঠান, যথা যজ্ঞ, হোম, উপাসনা, পূজা, স্তুতি, জীবনী ও পুরাণ কথা প্রভৃতি-সব ব্যাপারের উদ্দেশ্য তত্ত্ব জ্ঞানকে ব্যবহার গম্য করা। তদ্ভাব ও একাত্ম বোধের (Being and Becoming এর) আর্ট বা কৌশলই ঐতিহ্য, এইজন্য ঐতিহ্য ও বেদাংশ নামে পরিচিত। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ- দুই বেদ নামে আখ্যাত; মাত্র মন্ত্রে কোন কাজ হয় না, যদি মন্ত্র গুলির অর্থ প্রয়োগ জানা না থাকে।
বেদাঙ্গ ৬টি, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত, জ্যোতিষ। শিক্ষা- উচ্চারণ করার শাস্ত্র; কল্প- যজ্ঞ আদি নিরূপণ শাস্ত্র; নিরুক্ত- বৈদিক শব্দ অভিধান। উচ্চারণ যাতে ঠিক হয়, সে বিষয়ে শাস্ত্রকারদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল। সে সময়ে প্রাদেশিকতাও ছিল, যেমন ‘গম’ ধাতুকে সুরাষ্ট্র দেশে ‘হম্ম’ ধাতু ও প্রাচ্য মধ্য দেশে ‘রংহ’ ধাতু বলত; শব (মৃত দেহ) এই ধাতুটি কাম্বোজ দেশে গতিকর্মক (গমনার্থক) বোঝাত। এই রকম দুজন ঋষি ‘যদ্বা’ স্থানে ‘যর্দ্বা’ ও ‘তদ্বা’ স্থানে ‘তর্দ্বা’ উচ্চারণ করায় তাঁদের নাম হল ‘যর্দ্বা’ ঋষি ও ‘তর্দ্বা’ ঋষি। অন্য সময়ে উচ্চারণ যেমনই হোক, যজ্ঞ আদি কালে উচ্চারণ নির্ভুল হওয়া চাই, কারণ যে শব্দের যে উচ্চারণ সেই শব্দের অন্যরকম উচ্চারণে অর্থ ও ফল বদলে যেতে পারে; এই জন্য শিক্ষা শাস্ত্র জানা দরকার। দেব উদ্দেশে দ্রব্য ত্যাগ’ই যজ্ঞ।
ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বিবরণ আছে- কোন অনুষ্ঠানে কি দরকার, মন্ত্র গুলি কতভাবে ও কোন মন্ত্র কোথায় প্রয়োগ করতে হবে এ সমস্ত জানা যায় ব্রাহ্মণ গ্রন্থ থেকে। বিভিন্ন মতের মীমাংসা করা হয়েছে মীমাংসা দর্শনে। ঐ প্রকার অনুষ্ঠান আদির নাম কর্মকাণ্ড। ব্যাপক বা উচ্চ ভাব সকলে ধারণ করতে পারে না। উচ্চ ভাব ধারণ উপযোগী উচ্চ আধার চাই-দেহ মন চাই-সেই জন্য ভারতে সকাম সাধনার উদ্দেশ্য, যাতে এই জীবনে বা পর জীবনে আধার বড় হয়, যাতে ত্যাগ রূপ যজ্ঞানুষ্ঠানে ভোগ সমাপ্তির পর কর্মক্ষয়ের পর-উচ্চাধিকার লাভ হয়। ভারতে তর বহু স্থানে এই যজ্ঞানুরূপ অনুষ্ঠান দেখা গেলেও কোন স্থানেই সকাম সাধনার উদ্দেশ্য আর্যের ন্যায় ছিল না। দেব-উদ্দেশে দ্রব্য ত্যাগ ব্যাপার দুই ভাবে গ্রহণ হত, একটি সকাম বা সঙ্কীর্ণ ভাবে, অপরটি নিষ্কাম বা ব্যাপক ভাবে। ব্যাপক ভাবে যজ্ঞ মানে ত্যাগ; সেখানে বিশ্ব’ই দেবতা ও আত্মা’ই দ্রব্য অর্থাৎ বিশ্বের জন্য আত্মাহুতিই যজ্ঞ। এইরকম যজ্ঞের উপরই ছিল সমাজ প্রতিষ্ঠিত। বেদের ঐ ষড়ঙ্গের মধ্যে ব্যাকরণই প্রধান। ষড়ঙ্গের সাথে বেদ অধ্যয়ন ভিন্ন ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না। লোভ বা কোন প্রয়োজনের জন্য বেদ অধ্যয়নে ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না। হেতুশুন্য হয়ে (তপস্যার ভাবে) বেদ অধ্যয়ন করে জ্ঞান লাভ করলে ব্রাহ্মণ হওয়া যায়-(ব্রাহ্মণেন নিষ্কারণো ধর্ম্মঃ ষড়ঙ্গো বেদোহধ্যয়ো জ্ঞেয়শ্চিতি..ব্রাহ্মণেনাবশ্যং শব্দা জ্ঞেয়া ইতি”-মহাভাষ্য)। ব্যাকরণ জ্ঞান ভিন্ন যজ্ঞ আদি হয় না। বেদে অগ্নি দেবতার চরু নির্বাপণের মন্ত্র, “অগ্নয়ে ত্বা জুষ্টং নির্ব্বপামি।” সুর্য্যদেবতার মন্ত্র, ঐ স্থানে হবে, “সুর্য্যায়-নির্ব্বপামি”। এই যে বাক্য প্রয়োগের প্রভেদ, ব্যাকরণ জ্ঞান ভিন্ন জানা যায় না। বেদে লিঙ্গ ও বিভক্তি অনুসারে সব উক্ত হয় নি, এই জন্য বৈদিক ব্যাকরণ জানা দরকার। তাছাড়া ব্যাকরণে উচ্চারণ স্থান নির্ণয় করা আছে, হ্রস্ব দীর্ঘ নির্ণয় করা আছে, অল্প প্রাণ ও মহাপ্রাণ বর্ণ নিদিষ্ট করা আছে (ক বর্গ হতে প বর্গ পর্যন্ত প্রত্যেক ১ম ৩য় ও ৫ম বর্ণ ‘অল্পপ্রাণ’ এবং ২য় ও ৪র্থ বর্ণ, ‘মহাপ্রাণ’)। যে বর্ণের যে উচ্চারণ, সেই বর্ণের সেই উচ্চারণই থাকে, কোন অবস্থায় বদলায় না, যুক্তাক্ষরের বেলাতেও না। এই জন্য উচ্চারণ বৈকল্য দোষ বলে গণ্য হত। ব্যাকরণ নিয়ে অনেক বিচার আছে। এখানে আভাস মাত্র দিয়ে ক্ষান্ত হতে হবে। ‘লক্ষ্য লক্ষণে ব্যাকারণম্’ (মহাভাষ্য); লক্ষ্য লক্ষণকে ব্যাকরণ বলে। শব্দই লক্ষ্য, সূত্রই লক্ষণ; সূত্র ধরেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। এই লক্ষ্য লক্ষণ সম্মুখ ভাবই ব্যাকরণ, লক্ষ্য লক্ষণ যুক্ত অবয়ব নয়। অবয়ব লক্ষ্যেই প্রযুক্ত হয়ে ভিন্নার্থ হয়, লক্ষ্যের অক্ষর বা রূপ বদলায় না।
[উদাহরণ স্বরূপ ‘বঙ্গ’ শব্দটি গ্রহণ করা যাক। বঙ্গ = লক্ষ্য; ‘সুত্রানুসারে বঙ্গে বাস করে যে সে বাঙ্গালী’ = অবয়ব। এখানে ‘বঙ্গ’ শব্দটিতে ঙ+গ, এই যুক্তাক্ষর আছে, ঐ যুক্তাক্ষর মিলিত শব্দই ‘লক্ষ্য’, অবয়বে যদি ‘লক্ষ্যের’ রূপ বদলে যায় বা স্থান বিশেষে অক্ষর পরিবর্তন করতে হয়, ঐ সুত্রানুসারে ভুল হয়, (যেমন কোন স্থানে ‘বাঙালি’, কোন স্থানে ‘বাঙ্গালী’ ইত্যাদি)। বাঙ্গলায় অনেক পূর্ব রীতির পরিবর্তন হয়েছে, এমন কি স্বরানুসারে অধ্যয়নের রীতিও অপ্রচলিত। বহু পণ্ডিতের মত যে ঐ স্বরানুযায়ী রীতি প্রচলিত থাকলে অর্থবোধের বিশেষ সৌকর্ষ্য হয় ও ‘লক্ষ্যের’ ভাব সর্বদা সম্মুখে থাকে, নতুবা ভাব সৌন্দর্যের হানি হয়]।
ধ্বনি অনুযায়ী শব্দের ঝঙ্কার তোলা ভারতে তর কোন স্থানে নেই, একই লক্ষ্যে সকলের গতি, এ ভাব ও অন্যত্র নেই। মাত্র ম্লেচ্ছ দেশের Phonetic হিসাবে বানান ও উচ্চারণ অবৈজ্ঞানিক আত্মঘাতি ও লক্ষ্য হীন।
নিরুক্ত শব্দাভিধানে, শব্দের অর্থ বেদ হতেই সঙ্কলিত। ঐ সব শাস্ত্রের সকল গুলিতে বুৎপত্তি লাভ করে বেদাধ্যয়ন করা একজনের পক্ষে কঠিন। তাই ব্যবস্থা হল যে, অন্ততঃ ঐ সমস্ত শাস্ত্রের মূলতত্ত্ববোধ (Principle এর বোধ) ও ত্যাগ পূত জীবন থাকা চাই। বেদ বলেন, বেদ আবৃত্তিতে কোন ফল নেই, একমাত্র তত্ত্ব জ্ঞানেই জীবনের সার্থকতা। বেদের এই নির্দেশ ভুলেই আমাদের ব্যবহারিক জীবনে পঙ্গুতা এসেছে। যে বেদ আর্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ ভূমি, সেই বেদের ঐ রকম উক্তি ‘আবৃত্তিতে ফল নেই-এত বড় সাহসিকতা ও সত্য নিষ্ঠা ভারতেই সম্ভব, অন্যত্র কোথাও এ ভাব নেই। ভাবের ঐক্য, একই ভাবের প্রবাহ-আর্যের মধ্যে সকল দিকে, সব জিনিষই আর্যের কাছে একটি কৌশল-আর্ট বা ললিত কলা বিশেষ।
(চলবে )
আর্যপ্রভা-বেদ-২
বেদ-২
(সাধন নীতি)
ললিত কলা(আর্ট) বাহিরের ও অন্তরের সৌন্দর্য প্রকাশক। ঐ কলাকে তিন ভাবে দেখা যায়- সাধারণ শিল্প, মানস শিল্প ও অধ্যাত্ম শিল্প হিসাবে। ঐ শিল্প তিনটির বিভিন্ন লিঙ্গ, পৃথক সূত্র কিন্তু লক্ষ্য একই, সুতরাং ঐ তিন শিল্পের প্রত্যেকটি সাধন। যে সাধন ভাবে সমস্ত চিত্ত বৃত্তি নিরোধ করে অতীন্দ্রিয় রাজ্যের আস্বাদ আনে ও সে ভাবেই জীবনকে গঠন করে, তাকে মানস শিল্প বলা যায়। যোগ একটি মানস শিল্প। নিষ্কাম হয়ে, পবিত্র চিত্তে, শ্রদ্ধা ও বৈরাগ্যের সাথে যে সাধন ভাব আনা যায় ও সেই ভাবে ভাবিত জীবন হয়, তাকে অধ্যাত্ম শিল্প বলা যায়।
সাহিত্য নিজ ভাব বা আদর্শকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে, শিল্প ভাবকে বা আদর্শকে রূপ দেয়। আদর্শকে আকার দেওয়াই শিল্পের বিশেষত্ব। আদর্শ ভাবাত্মক শিল্পই ললিত কলা(আর্ট)। তার ভাষা লিঙ্গাত্মক বা ইঙ্গিতাত্মক। ঐ ভাষায় সুন্দর ভাবকে উচ্চ ও মহান ভাবকে রেখা ও বর্ণে প্রকাশ করে, আর যা প্রকাশ করে তার সমস্ত গুণ ও লক্ষণকে রূপ দিয়ে নতুন ছাঁচ (type) গঠন করে। একাগ্র ও একনিষ্ঠ কর্ম কৌশলই যোগ-মানস শিল্প। এই শিল্প সহায় ভাবকে-সাধনাকে যথাযথ বিনিয়োগ করতে পারা যায়, অন্তরের মানুষটি মাথা চাড়া দিয়ে খাড়া হবার চেষ্টা পায়; আসে তখন শ্রদ্ধার ভাব, আত্ম শ্রদ্ধাও জেগে ওঠে। শ্রদ্ধার জাগরণে পবিত্রতা স্বপ্রকাশ হয়, কারণ পবিত্রতাই ভেতরের স্বভাব। একনিষ্ঠার একান্ত অভাবে বা উচ্ছৃঙ্খলতায় পাঁচটি ভাব এলোমেলো ভাবে মিশে, উদয় হয় যেটা, সেটা অপবিত্রতা বা অশুদ্ধতা। এই যে অন্তর বাহির এক হয়ে একনিষ্ঠ বা শুদ্ধ ভাব জাগিয়ে তোলা অর্থাৎ মন-মুখ এক করা, এটাই অধ্যাত্ম শিল্প।
অধ্যাত্ম ভাব রূপক হয়, যতক্ষণ তা কল্পনায় থাকে। কবি কল্পনায় এটা সুন্দর ও মধুর, কিন্তু যখন উহা সাধক জীবনে প্রতিফলিত হয়, তখন সেটি বাস্তব সত্য। ব্রজভাব কবি কল্পনায় কমনীয় ও মধুর, মহাপ্রভুর জীবনে ব্রজভাব চলমান সত্য। কবি কল্পনাকে মাত্র সুষমা মণ্ডিত করতে পারেন, সাধক তাকে প্রত্যক্ষ করেন। কল্পনার ডাক, তার তোড় জোড়, সবই হৃদয় বৃত্তির সুষমা বিকাশের জন্য; আবাহন ও স্থাপন হয় প্রাণবন্তেরই।
পাশ্চাত্যের যুক্তি, “কল্পনার খপ্পরে পড় না, Idealistic হয়ও না, সেটি Unnatural, অস্বাভাবিক; বাহ্য ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য Nature বা দৃশ্য প্রকৃতিই Realistic বা বাস্তব, অতএব সাধনা Realistic এরই হওয়া উচিত” শিল্প মানে যদি একমাত্র Nature বা বাস্তবকে আকার দেওয়ার প্রচেষ্টাতে পর্যবসিত হয়, সেটি কি ঐ Nature এর একটা অনুকরণ প্রয়াস মাত্র নয়? অনুকরণই কি তৃপ্তিদায়ক, তাতে কি জীবনের সার্থকতা আনে? আমাদের বিশেষত্ব, আমাদের মৌলিকত্ব, আমাদের অন্তর্নিহিত উদ্ভাবনী শক্তির কৌশল আমাদের Creative art-কি প্রস্ফুটিত হবে অনুকরণে? উচ্চ ভাবের প্রকাশ, মানবতার ইঙ্গিত, কি মাত্র অনুকরণে হয়, না হতে পারে? আর কল্পনার নামে নাক সটকানোর কি আছে, অনুকরণেও তো কল্পনার দরকার, বর্ণ ও রেখা ফলাতে গেলেও তা মাথা ঘামাতে হয়? ঐ রকম কল্পনায় রূপ দেখা দিলে, সেটি হয় বাস্তব, আর উচ্চ মহান ভাবকে রূপদান করাটাই বুঝি অবাস্তব, অস্বাভাবিক? পাশ্চাত্য natural (স্বাভাবিক) তিনটি কে বোঝায়, যথা- (১) জীবন সংগ্রাম (Struggle for Existence), (২) বেঁচে থাকার সহজাত বোধ (Instinct of Self-preservation), (৩) বংশবৃদ্ধি (Reproduction of Species) ঐ তিনটে জিনিষ যাতে বজায় থাকে সেটাই পাশ্চাত্যের natural (স্বাভাবিক), আর তার ফলে আসে যোগ্যতমের উদ্বর্তন(Survival of the fittest)। জীবন সংগ্রাম, বেঁচে থাকার ইচ্ছা ও বংশ বৃদ্ধি ঐ তিনটিই- উদ্ভিদ, কীট, অনুকীট ও জন্তু জানোয়ার হতে মানুষ পর্যন্ত সর্ব স্থানেই রয়েছে ও তার ফলে যে যোগ্যতমের উর্দ্ধতন হয়, তার মানে তো দাঁড়ায়, যে দৈহিক বলে বলবানেরই আছে বেঁচে থাকার অধিকার, বুদ্ধির খরচটাও হয় ঐ জন্যে। গতানুগতিক জীবনকে তুচ্ছ করে আপন আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে ও জয় করতে, নব নব উপায় আবিষ্কার করতে সদা অগ্রসর যে মানব, সেই মানুষে জৈব প্রয়োজনের (Biological necessity) সব বিধি খাটানো কি সম্ভব? মানব মন চায় সর্বজয়ী হয়ে লাভ করতে তৃপ্তি। পাশ্চাত্য স্বাভাবিকতা, দেহ রক্ষার জন্যই জীবন সংগ্রামে প্রায় সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে।
সেখানে কোথায় সৌন্দর্য বোধের অবসর, কোথায় বা তৃপ্তি? উল্লেখিত তিনটিকে ভারত দেখেছেন অন্য দৃষ্টিতে। বেঁচে থাকার ইচ্ছা মানে অন্তর্নিহিত একটি প্রবল প্রেরণা; আর সেই প্রেরণাবশেই আসে জীবন সংগ্রাম। অণু পরমাণু হতে সর্ববস্তু নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে-সর্বত্রই ঐ ইচ্ছা, অতএব অমরত্বই সর্ব বাস্তবের প্রয়োজিকা শক্তি। পাশ্চাত্য বলেন যে, জীবন সংগ্রামে যোগ্যতমরাই টিকে যায় (Survive করে)। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে কিন্তু আমরা দেখি যে Death, মৃত্যুই বরাবর সকলকে Survive করে, মৃত্যুই চিরজীবী; তা হলে কি Death মৃত্যুই Fittest যোগ্যতম বস্তু? এখানে উত্তর আসে যে, জীব বংশধারা বজায় রেখে মৃত্যুকে ফাঁকি দেয়। এই রকম যুক্তিতে এটাই প্রমাণ হয় যে ব্যক্তিগত হিসাবে, মৃত্যু সকলের টুঁটি চেপে ধরে, কিন্তু বংশধারা বা প্রবাহ রূপে অমরত্বই টিকে থাকে। কিন্তু তাও কি সর্বাবস্থায় ঠিক ? জীব জগতের সর্বক্ষেত্রে এক একটি জাতির লোপ হয় কেন ? জগৎ হতে তাদের অস্তিত্ব মুছে যায় কেন ? কোথায় এখন পৃথিবীর আদিম অবস্থার উদ্ভিদ বা জীবজন্তু ? কোথায় পুরাতন ভারতেতর জাতির সভ্যতা ?
ভারত বলেন, ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য দৃশ্য বিশ্বের, এই Nature এর-বস্তু-মাত্রেরই লক্ষণ অনিত্যতা অর্থাৎ সমস্তই প্রত্যেকটিই পরিণামী ও পরিবর্তনশীল জড়। পরিণাম প্রাপ্তি ও পরিবর্তনশীলতা থাকবেই জড়ে সর্বাবস্থায়। এই পরিণাম প্রাপ্তি প্রভৃতি কে মৃত্যু (Death) আখ্যা দেওয়া হয়। পরিণাম প্রাপ্তি, পরিবর্তন মানে বহুত্ব; অতএব বহুত্ব বন্ধ হলেই, তার পথ রুদ্ধ হলেই, অর্থাৎ তার গতিকে মোড় ফিরিয়ে একত্বের দিকে চালিয়ে দিয়ে ঐ মূল প্রয়োজিকা শক্তির সঙ্গে একাত্মতা বোধ এলেই, আসে অমরত্ব। বেদ বলেন ‘তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি’, ‘তাকে জানলেই মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায়; এই জানা মানে, প্রকৃতির স্বরূপ জানা। এই মৃত্যুকে জয় করা রূপ কৌশলই অধ্যাত্মশিল্প; এখানে বংশ ধারার (Reproduction of Species বা Multiplication এর) প্রশ্নই আসে না-একত্বে বহুত্বের স্থান কোথায় ? ঐ কৌশল অবশ্য ব্যক্তিগত, কিন্তু ঐ প্রয়োজিকা শক্তি প্রত্যেককেই একত্বের পথে চালিত করছে। প্রকৃতির রহস্যই তাই, উদ্দেশ্যও তাই। অধ্যাত্মশিল্পী, ত্যাগ প্রেম ও সংযমের জীবন যাপন করে দেখিয়ে দেন তপস্যার দ্বারা প্রতিপন্ন করেন, যে জৈব সংস্কারকে অতিক্রম করাই স্বাভাবিকতা প্রাপ্তি, বহুত্বে হাবুডুবু খাওয়াটাই অস্বাভাবিক অবস্থা। বেদ বলেন ‘দ্বৈতাৎ ভয়ং’-বহুত্বেই ভয়, বহুত্বেই সংগ্রাম, বহুত্বই অশান্ত অবস্থা। একত্বেই নির্ভিকত্ব, একত্বেই শান্তি, একত্বেই আত্মশ্রদ্ধা, একত্বেই আত্মপ্রত্যয়।
শ্রদ্ধা ভিন্ন চিত্ত প্রসন্নতা আর কিসে বেশী হয়? চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তি, সৌন্দর্য, কি শুধু মাংসপেশীর সঠিক চিত্র? চিত্রের পেছনে আসল মানুষটির, যেটা সব চেয়ে বাস্তব, সেটির রূপ ফুটিয়ে তোলা কি সূক্ষ্ম ও গভীর সৌন্দর্যের পরিচয় নয়? অধ্যাত্মশিল্প শাশ্বত কে রূপ দেয়। এই প্রচেষ্টাতে ধ্যান এনে দেয়, যে ধ্যান ঐ শিল্পের সঞ্জীবনী শক্তি। ধ্যানে যে রূপ প্রকাশিত হয় তাতে সর্ব বৃত্তির চরম তৃপ্তি আসে, অপবিত্রতা সেখানে ঘেষতেই পারে না। তাতে একাত্মতার মানবতার স্ফুরণ হয় বলেই সেটি দেশকাল জয়ী চির নতুন, সেটি অন্তরের আর্ট, মানব প্রাণের রূপ। সেটি কোন ব্যক্তিবিশেষে আবদ্ধ নেই বলেই সনাতন ও সত্য স্বরূপ। অধ্যাত্মশিল্পী বলেন যে তন্ময়তা হৃদয়ের আত্যন্তিক আগ্রহ আর্টকে প্রত্যক্ষ করায়, বর্ণ ও রূপে আর্ট সামনে এসে দাঁড়ায়, বাস্তব হয়ে দাঁড়ায়। এই যে সাধন পথ তার অর্থ টিকি বা হাঁচি টিকটিকির ব্যাখ্যার মত রূপক নয়। ললিতকলা বা আর্ট ভাবকেই রূপ দেয়; শিল্পীর আদর্শ ফুটে ওঠে। প্রশ্ন এই যে, অধ্যাত্ম আর্ট কি সেই রূপকে চলমান জীবন্ত প্রাণ সম্পন্ন বাস্তবে পরিণত করতে পারে না ?
আর এক দিক দিয়ে পাশ্চাত্য Survival of the fittest কীট পতঙ্গ, জন্তু জানোয়ার, জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে বাঁচে, একটা আরেকটাকে মেরে। মানুষকে জীবন রক্ষা করতে হলে ঐ উপায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করে এগুতে হয়। মানুষ কি ঐ পশুনীতি অতিক্রম করতে পারেনা ? ওরকম জীবন সংগ্রাম মানে যুদ্ধ ও সংঘর্ষ। পরিবর্তন ও পরিণাম মানে মৃত্যু। যুদ্ধ ও সংঘর্ষ বরণ করে, মৃত্যু বরণ করে, বেঁচে থাকার যে ইচ্ছা, তার মানে কি ? মৃত্যু বরণ করে কি Survive করা যায় ? বংশধারা রক্ষাতেই মৃত্যুকে ফাঁকি দেওয়া যায়, এই যুক্তি মেনে নিলে দাঁড়ায় – (১) মার ধোর করে বেঁচে reproduction করে fittest হওয়া, ও Survive করা, (২) বংশধারা বজায় রাখাতেই রয়েছে অমরত্ব। অমরত্বর কি তা হলে fittest নয়? ভারত বলেন, সংগ্রাম থাকবেই কিন্তু
“সংগ্রাম অপার সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা
চূর্ণহোক স্বার্থ সাধ মান হৃদয় শ্মশান নাচুক তাহাতে শ্যামা।”
ঐ কবিতার অর্থ নিয়ে আলোচনা এখানে উদ্দেশ্য নয়, উক্ত দুই লাইনের অর্থ পরিস্কার। আর এক কথা; fitness বা যোগ্যতা আছে বলেই সংগ্রামরত দল সংঘর্ষে অগ্রসর হয়, fitness বা যোগ্যতা আছে বলেই একজন বা উভয়েই Survive করে। Fitnessটি সর্বদাই আছে। দেখা যায়, মানুষের মধ্যে সৈন্যশক্তি দুর্বল অথবা যুদ্ধ উপকরণ দুর্বল দলও বুদ্ধিবলে জয়ী হয়-fit হয়। এখানে পশুবল অপেক্ষা বুদ্ধিবল প্রধান, পশুজগতের নিয়ম মানুষ এখানে অতিক্রম করেছে। জীব হলেই জৈবিক প্রয়োজন থাকবে, এই প্রয়োজনবোধ সহজাত। পশু তার প্রয়োজন বা অভাবকে কমাতে জানেনা ও পারেনা। অভাব মেটাবার জন্য লড়াই করতে সে বাধ্য। মানুষের কিন্তু এমন শক্তি আছে যার সহায়তায় সে তার সমস্ত অভাবকেই-তার তাড়নাকেও-অতিক্রম করতে পারে ও জানে। অভাব তৃপ্তির কৌশলও সে জানে। পশুর জীবন রক্ষার বিধি মানুষে খাটালে, মানুষ পশুত্ব প্রাপ্ত হয়। ভারতের Struggle for Existence মানে আত্মরক্ষা-আত্মাকে রক্ষা- পাকা আমি’কে দেহ, মানবুদ্ধিবদ্ধ কাঁচা আমির তাড়নার অভিযান হতে রহ্মা করা, বজায় রাখা, পাকা আমিত্ব প্রাপ্ত হওয়া। ভারত বলেন- সংঘর্ষ ও লড়াই তাই তোমার কাঁচা আমির সঙ্গে, তোমার অন্তঃ প্রকৃতির ও বহিঃ প্রকৃতির সঙ্গে। কাঁচা আমির গোলামী করাকে স্বাধীনতা বলেনা। ‘স্ব’ কে ফুটিয়ে তোলাই দেহ মনবুদ্ধির ঐ ‘স্ব’ এর অধীন হয়ে চলাই স্বাধীনতা। যে শক্তি সর্বত্র ঠেলা দিয়ে ক্রমাগত আত্ম বিকাশ করার চেষ্টা করছে, তা রয়েছে সকলের মধ্যে, অতএব যোগ্যতা আছে সকলের। জীবের মধ্যে মানুষেই ঐ শক্তি সর্বাপেক্ষা বিকশিত বা উন্নত বলেই, মানুষই ঐ একত্ব পাবার যোগ্যতম আধার। মানুষ যে অমৃতের অধিকারী এটা জানা দরকার প্রত্যেকের। এই জানা মানে কেবল তোতাপাখীর মত বচন আবৃত্তি নয়, খালি মাথা দিয়ে বুঝে ফেলা নয়। বেদ বলেন-
“তস্যৈ তপো দমঃ কর্ম্মেতি প্রতিষ্ঠা বেদাঃ সর্ব্বাঙ্গাণি সত্যমায় তনম”। (কেন ২-৩৩)
সত্যায়তন সাঙ্গ বেদ- তপস্যা, দম(বৈরাগ্য) ও কর্মে প্রতিষ্ঠিত। অতএব, জানা মানে সাধন ফল। যাঁরা বলেন যে সত্য লাভের জন্য তপস্যার দরকার নেই বা উপাসনাদি কর্মের দরকার নেই- সে সব চেষ্টারও আবশ্যকতা নেই, ঐ সব লোকের সঙ্গে ব্যবহারে শাস্ত্রকারেরা সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছেন, তন্ত্র শাস্ত্র তো তাঁদের ভণ্ড, প্রবঞ্চক ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করেছেন। শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞান এক জিনিষ নয়, আলোচনা ও জানা এক বস্তু নয়। আদর্শকে ছোট করে দেখার অধিকার কারোর নেই। জীবনযাপন চেষ্টা বিহীন মুরুব্বিয়ানা বড় বড় কথার মূল্য কতটুকু ?
( চলবে)
উল্লেখা আর্যপ্রভার লেখা সমূহ পড়ে আপনার মতামত জানাবেন। এবং কপি নয় শেয়ার করার মাধ্যমে আমাদের সহায়তা করুন!
আর্যপ্রভা-বেদ-৩
বেদ-৩
“মানস শিল্পের উদ্দেশ্য নিহিত বীর্যকে প্রকাশ করা। ভারতেতর দেশে এর আভাস মাত্র। অধ্যাত্ম শিল্প-ভারতের আদর্শ। সত্যং শিব সুন্দরং। জ্ঞানকাণ্ড, উপাসনাকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড-উদ্দেশ্য। সংহিতা চতুষ্টয়ই চারবেদ। ব্যাসদেব। সরহস্য চতুর্বেদ-শাখা। বাকোবাক্য, ইতিহাস, পুরাণ, বৈদ্যক। শৌনকের চরণব্যুহ। কৌথুমী ও রাণায়ণ। ভেদ বা প্রস্থান। বেদব্যাস উপাধি বহু। পৈল, জৈমিনি, বৈশম্পয়ন, সুমন্ত্র। যাজ্ঞবল্ক্য। বাজসনী, বাজসনেয়। শুক্ল যজুর্বেদ। কৃষ্ণ যজুর্বেদ। ঈশোপনিষৎ। ভৃগু, অথর্বা-আসন। অঙ্গিরা। স্বাহা-অর্থ। যজমান, ঋত্বিক, হোতা, অধ্বর্য্যু। যজ্ঞ-শরীর। উদগাতা। ব্রহ্মা। হোতৃক্রিয়া, উদ্গান, ব্রহ্মক্রিয়া। স্বর্গ। নিরুক্ত। বৈয়াকরণের যাজক। প্রজাজ মন্ত্র। বেদ ও তন্ত্র-দ্বিবিধ শ্রুতি। প্রভেদ। ব্রাহ্মণ, আত্মন, শক্তি। ব্রাহ্মণ ও স্ফোটবাদ। Alexandrian School। শক্তি গঠনের মূল ভাব অন্যত্র নেই। দুহিতা। প্রথম হতেই ভারতের আদর্শ। আপ্তবাক্য। মত বা জ্ঞান। ঋষি। বোধে বোধ। ব্রহ্মবিদ্যা ও তার ধারা। শ্রুতিকণ্ঠস্থ বিদ্যা নয়। বেদ, ছন্দকে অতিক্রম করেছেন। কীর্তন। নানা ছন্দ। ছান্দম। মাহেশ্বরী সূত্র। অধ্যয়ন-সংস্কার কার্য্য। পুরুষার্থ। চার রকমে বিদ্যার স্ফুর্তি। প্রথম গানই সামগান। চার রকম শব্দ, ব্রহ্মার চারি বদন। ব্রহ্মযজ্ঞের জুহূ, উপভূত, ধ্রুবা, মেধা, অবভৃথ স্নান, উদ্ষন।”
সাধন দ্বারাই সত্যজ্ঞানের উদয় হয়, অনিত্যতার আবরণ অপসারিত হয়, নিত্যতার স্ফূর্তি হয়। শিল্প শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলে, জীব মাত্রেই শিল্পী। জোনাকী পোকা আলো দিয়ে আহার অন্বেষণই করুক বা নিজ প্রিয় কে আহবানই করুক, সে তার ভেতরের আকর্ষণী শক্তিকেই কাজে লাগাচ্ছে; মানুষ যখন শিল্প সহায়ে এই নিহিত বীর্য কে সামনে ধরার চেষ্টা না করে মাত্র অনুকরণ করে ও বাইরের রূপটি মাত্র প্রকাশ করে সেটিকে সাধারণ শিল্প বলা যায়। এই রকম সাধারণ শিল্প বা কারুশিল্পও, বর্ণ ও রেখায় নয়ন আনন্দদায়ক হয়, শিল্পীর চেষ্টা থাকে সকলের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করার। অনুকরণের বস্তুকে যখন চেনার, বোঝার চেষ্টা হয়, তখন ঐ শিল্পী আর এক ধাপে উঠেন। তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত হয়। ভাবের সঙ্গে মিশে গেলে, ভাব আয়ত্তের মধ্যে আসলে, অনুকরণ আর অনুকরণ থাকে না, সেটি বাস্তব হয়ে দাঁডায়। মানসশিল্পের উদ্দেশ্য শিল্প ও শিল্পীকে এক করা, একাত্ম করা, ঐ নিহিত বীর্যকে প্রকাশ করা, ঐ নিদ্রিত ভুজঙ্গকে জাগ্রত করা। ভারতেতর দেশে সর্বত্র আজও ঐ কারুশিল্পের প্রথম দুটি ধাপ শিল্পী অতিক্রম করতে পারেন নি, মানস শিল্পের আভাস মাত্র পেয়ে তাঁরা ক্ষান্ত হয়েছেন। ক্বচিৎ কোথায় কে অতিক্রম করেছেন তার কথা হচ্ছে না। গোড়া থেকেই ভারতের আদর্শ অধ্যাত্মশিল্প। ভারতের শিল্পী সর্বত্র বহুতে একেরই প্রকাশ দেখার জন্য লালায়িত। অধ্যাত্ম শিল্পের রূপই দেখাতে তাই তাঁরা চেষ্টা করেছেন। চিত্রে, ভাস্কর্যে, সঙ্গীতে, সাহিত্যে, জীবনের প্রত্যেক খুঁটিনাটিতে। অন্যত্র, বহুকে পৃথক পৃথক ভাবে বোঝার চেষ্টায়, রূপ ও বিভূতি, মানুষের ভোগ সাধনে, মানুষেরা সুখ সুবিধার জন্য নিয়োজিত। ভারত অন্তরের রূপকে- সত্যং শিবং সুন্দরম’কে ধরে বহুর মধ্যে বিচরণ করেছেন। অন্তরের সুন্দরে তিনি মুগ্ধ, বাইরের রূপ হয়ে গেছে তার কাছে তুচ্ছ তখন, ভুলেছেন তিনি সব, ঐ সুন্দর অন্তর ও বাহিরে সর্বত্র। অন্যত্র, বাহিরের রূপই প্রধান, বহির্জগতের সঙ্গে ব্যবহারে যে ভাব ফুটে ওঠে তারই প্রকাশে শিল্পী যত্নবান। এখন সময় এসেছে ঐ উভয়ের আদান প্রদানের।
অধ্যাত্মশিল্পরূপ সর্ব প্রাচীন সঙ্কলিত শব্দরাশি বেদ, জ্ঞানকাণ্ড, উপাসনাকাণ্ড ও কর্মকাণ্ডে বিভক্ত, জ্ঞানকাণ্ডকে ব্যবহারগম্য করবার জন্যই উপাসনা ও কর্মকাণ্ড। বেদ তিন, কিন্তু অতি বৃহৎ বিধায়, অধ্যয়নের ও অন্যান্য সুবিধার জন্যই ব্যাসদেব দ্বাপরে বেদকে চারভাগে বিভক্ত করেন, প্রত্যেকটির পৃথক নাম দেন। অধিকাংশ ঋক (সাধারণতঃ আহুতির মন্ত্র) যাতে আছে তার নাম ঋক সংহিতা, যে সব ঋক গীত হয় তার নাম সামসংহিতা, গদ্যাংশ একত্র করে নাম হয়েছে যজুঃ সংহিতা; অবশিষ্ট মন্ত্র যাতে আছে তার নাম অথর্ব সংহিতা। অথর্ববেদে যেমন শান্তি, অভিচার আদি মন্ত্র আছে, তেমনি ব্রহ্মতত্ত্বের নিগুঢ় রহস্যও আছে। ব্যবহারিক প্রয়োগ ও প্রকরণ বশে ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদের মধ্যে কতকগুলি সাম ও যজুমন্ত্র আছে, সামবেদের মধ্যেও কতকগুলি ঋক ও যজুঃ আছে, যজুর্বেদের মধ্যেও কতকগুলি ঋক ও সাম আছে। মন্ত্রের প্রাধান্য অনুসারে বেদের নামকরণ হয়েছে। বর্তমানে ঐ সংহিতা চতুষ্টয়’ই চতুর্বেদ নামে পরিচিত।
ঋক সংহিতায় আছে ১০ হাজার মন্ত্র সংখ্যা, অথর্ববেদের কিছু কম ৬ হাজার। মহাভাষ্য (পণ্ডিত রজনীকান্ত বিদ্যারত্ন কর্তৃক অনুবাদিত-উদ্বোধন ১ম বর্ষ দ্রঃ) হতে জানা যায় যে সরহস্য চতুর্বেদ বহু প্রকার; অর্ধ্বয্যুর (যজুর্বেদের) শাখা ১০০, সামবেদের ১০০০ হাজার, বাহ্বচ্য ২১ প্রকার, অথর্বেবেদ ৯ রকম। এ ছাড়া বাকোবাক্য (উক্তি প্রত্যুক্তিরূপ গ্রন্থ), ইতিহাস (পূর্বতন লোকের চরিত্র বর্ণন গ্রন্থ), পুরাণ (প্রাচীন কথা) ও বৈদ্যক (চিকিৎসা শাস্ত্র) শাস্ত্র আছে। বিভিন্ন শাস্ত্রের নামের শেষে বেদ এই শব্দটি যুক্ত আছে। সব গুলির লক্ষ্য এক, যথা- জ্যোতির্বেদ, ধনুর্বেদ ইত্যাদি। পণ্ডিতেরা বলেন যে ঋগ্বেদে প্রক্ষিপ্ত নেই বললেই হয়, তার কারণ ঋগ্বেদের শ্লোক সংখ্যা, প্রতি শ্লোকের পদসংখ্যা, শব্দাংশের পরিমাণ, প্রত্যেক সূক্তে কতগুলি অকারান্ত, ইকারান্তাদি পদ আছে তা সমস্তই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পৈল শিষ্য-ইব্দ্রপ্রমতি ও বাস্কল ঋক সংহিতাকে দুভাগ করেন, শেখার সুবিধার জন্য। বাস্কল আবার তাকে চারভাগ করেন ও তাঁর ৪ জন শিষ্যকে শেখান; মাণ্ডুককে শেখান ইন্দ্রপ্রমতি। শৌনক চরণব্যূহ নামে বই লেখেন, তিনি লিখেছেন যে ঋগ্বেদের ৮টি শাখা থাকলেও অধিকাংশ পুর্ণ পাওয়া যায় না, ৫টি শাখা লুপ্ত। সামবেদের উত্তর ও পূর্ব এই দুই শাখার বহু প্রশাখা ছিল, এখন মাত্র দুটি পাওয়া যায়। কৌথুমী ও রাণায়ণ নামে দুইজন ঋষি ছিলেন। বাংলা দেশের অধিকাংশ ব্রাহ্মণ কৌথুমী শাখার অন্তর্গত। অথর্ববেদেরও অনেক অংশ এখন পাওয়া যায় না। ঋগ্ধেদের ৮টি শাখাকে ভেদ বা স্থান বলা হয়।
বেদ বিভাগ করায় ব্যাসদেবের নাম হয় বেদব্যাস, তিনি শ্রীকৃষ্ণের সমসাময়িক। ব্যাসদেব নিজের চার শিষ্যকে বেদ পড়ান; শিষ্যেরা- পৈল-ঋগ্বেদ; জৈমিনী-সামবেদ; বৈশম্পায়ন-যজুর্বেদ, সুমবত্র-অথর্ববেদ। ঐ সব শিষ্যেরা আপন আপন শিষ্যকে পড়ান ও তারা পুনরায় বেদকে নানাভাবে বিভক্ত করায় তাঁরা ও বেদব্যাস নামে পরিচিত হন। যাজ্ঞবল্ক্য নিজগুরু বৈশম্পায়নের কাছে একটি শাখা পান। গুরুর সঙ্গে তাঁর বিশেষ মতভেদ হয়। যাজ্ঞবল্ক্য সে শাখা ত্যাগ করেন, গুরুর কাছে অভিশপ্ত হয়ে চলে যান ও অধীত বিদ্যা ভুলে যান। তিনি কঠোর তপস্যা আরম্ভ করেন। সূর্য্যদেব বাজী(অশ্ব) রূপ ধারণ করে তাঁর বাজ(কেশর) হতে বিদ্যা দান করেন। যাজ্ঞবল্ক্য যা পান তার নাম বাজসনী আর মন্ত্রগুলি বাজসনেয়। এই নতুন শাখার নাম শুক্লযজুর্বেদ; যেটি তিনি ত্যাগ করেছিলেন তার নাম কৃষ্ণ যজুর্বেদ। অধিকাংশ উপনিষদগুলি ব্রাহ্মণভাগের বা মন্ত্রভাগের শেষে আছে, কিন্তু বাজসনেয় সংহিতোপনিষৎ আছে শুক্লা-যজুর্বেদীয় বাজসনেয় সংহিতার শেষে। এই বাজসনেয় সংহিতোপনিষদের মধ্যে ঈশোপনিষৎ কে পণ্ডিতেরা সর্বপ্রথম ও শ্রেষ্ঠস্থান দেন।
ব্রহ্মার এক মানসপুত্র ভৃগু, অথর্বা ঋষি নামে বিদিত। অথর্বার পরে অঙ্গিরা ঋষিত্ব লাভ করেন। অথর্ব হয়ে যায় আসনের নাম, সেই রকম অঙ্গিরাও একটি আসন। যেমন Magistrate একটি আসনের নাম, কোন ব্যক্তি বিশেষের নয়। সেই রকম ২০ জন অথর্বা ও অঙ্গিরার নাম পাওয়া যায়। ঐ ২০ জনের হৃদয়ে বেদ প্রকাশিত হন, এটাই অথর্ববেদ বা অথর্বাঙ্গিরস। এই বেদের ৫টি উপবেদ। সকাম ও নিষ্কাম সাধক সকলের জন্যই সাধনক্রম তাতে আছে। অথর্ববেদের পূর্ব ও উত্তরকাণ্ডের মধ্যে, সায়ন পূর্বকাণ্ডের টীকা করেছেন। উত্তরকাণ্ড এখন দুষ্প্রাপ্য, লুপ্ত না হলেও।
ব্যাপক ভাবে বৈরাগ্যময় জীবনই যজ্ঞ। ত্যাগ কর্মের নাম আহুতি। অগ্নিতে ঐরূপ প্রক্ষেপই আহুতি। স্বাহা উচ্চারণ করে আহুতি দিতে হয়। ব্যাপক ভাব বরাবর আছে। পুরাণে, স্বাহা অগ্নির স্ত্রী। শ্রীশ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থ (গৌড়ীয় বৈষ্ণব) মতে, ‘স্বা শব্দেন চ ক্ষেত্রজ্ঞো হে তি চিৎ প্রকৃতি পরা।’ স্বা= জীবাত্মা-শ্রীমদ্ভগবৎগীতায় এই শব্দের প্রয়োগ আছে। তন্ত্রে, ‘বিশ্বস্য লয়ঃ স্বাহার্ণকে ভবেৎ স্বাহা’- স্বাহা এই বর্ণেই বিশ্ব লয় হয়। যার হিতের জন্য যজ্ঞ করা হত তার নাম যজমান। ঋত্বিক (যাজক) করতেন যজ্ঞ। বড় বড় যজ্ঞে তিনজন ঋত্বিক থাকতেন। ঋগ্বেদী প্রধান যাজক বা হোতাই দেবভাব আহবানকারী, তিনি আহুতি দেন না। যজ্ঞের উপযোগী দ্রব্য হব্য প্রস্তুত করা ও যথাসময়ে হব্য অগ্নিতে প্রক্ষেপ করা ছিল অধ্বর্য্যুর কাজ (অধ্বর= স্বর্গের পথ প্রদর্শক)। বেদি নির্মাণাদিতেই যজ্ঞ-শরীর নির্মিত হয়। যিনি এটা করেন, তিনিই অধ্বর্য্যু। হব্য আদি প্রক্ষেপের সময় যজুর্মন্ত্র বলতে হত, সুতরাং অধ্বর্য্যু ছিলেন যজুর্বেদী ঋত্বিক। বড় বড় ক্রিয়ায় তার সহকারী থাকত। বেদ পাঠে বাণী শুদ্ধ চাই, সুতরাং সুস্পষ্ট উচ্চারণ করতে হত। ঋকমন্ত্র উচ্চৈস্বরে, যজুমন্ত্র নিম্নস্বরে বলতে হয় ও সাম গীত হয়। সাম গানের প্রধান ঋত্বিকই উদগাতা। সর্ববেদীয় ঋত্বিকের ভুল ভ্রান্তি দেখার জন্য বা সংশোধন করার জন্য সর্বোপরি একজন ঋত্বিক থাকতেন, তাকে বলা হত ব্রহ্মা, সুতরাং ব্রহ্মা হতেন ত্রিবেদী। ব্রহ্মার এই পর্যবেক্ষণ অথবা ত্রুটি সংশোধন ক্রিয়ার নাম ব্রহ্মক্রিয়া। হোতৃক্রিয়া ঋক্মন্ত্রে, উদগান ক্রিয়া সামমন্ত্রে ও ব্রহ্মক্রিয়া অথর্বমন্ত্রে হত।
স্বর্গ কামনায় অনেক সময়ে যজ্ঞ হত, বলা বাহুল্য বেদের স্বর্গ ও পুরাণের স্বর্গ এক জিনিষ নয়। বেদে স্বর্গ= জ্যোর্তিলোক। নিরুক্ত না পড়লে বৈদিক মন্ত্রের পদবিভাগরীতি, এমন কি বাচনিক অর্থও বোধগম্য হয় না। তখনকার অর্থ এখন সব সময়ে নেই। উদাহরণ স্বরূপ ঋক্ ১/১/৪/২ এ (ঘৃতাচীং এর) ঘৃত=উদক বা জল যাস্ক ও সায়ন মতে। কিন্তু পাশ্চাত্য অর্থ অনুসরণ করে, পণ্ডিত রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয় উদ্ধৃত ঋকের অর্থ করেছেন, পূতদক্ষ মিত্র ও শত্রুনাশক বরুণকে আমরা এসে প্রার্থনা করছি, তারা এসে ঘি দিয়ে আহুতি দিন; যাস্ক ও সায়ন মতে মানে হয় যে তারা উদক প্রেরণারূপ কর্ম সম্পাদন করেন। অর্থাৎ পূতদক্ষ মিত্র ও রিপুনাশক বরুণকে আহ্বান করা হচ্ছে যেন তারা প্রেরণা দেন।
[(পণ্ডিত লক্ষ্মীনারায়ণের নিরুক্ত সম্বন্ধে লেখা দ্রঃ) মিত্র ও বরুণ বেদের দুই দেবতা সুর্যেরই দুই রূপ। সূর্য যখন শিরোভাগে তখন তিনি মিত্র, যখন অধোভাগে তখন বরুণ। এইরকম চন্দ্রের আর একটি নাম গন্ধর্ব ও সুর্যের যে সমুদয় রশ্মি চন্দ্রকে দীপ্তিমান করে তার নাম সুষুম্ন।]
বৈদিক বৈয়াকরণদের মধ্যে যাজক শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ ছিল। প্রজাজ মন্ত্র সব বিভক্তি যুক্ত করে ব্যবহার করতে হত ও যিনি বাক্যকে পদানুসারে এবং বর্ণানুসারে ব্যবহার করেন তিনি আত্মিজীন অর্থাৎ যাজক বা যজমান।
বেদের আর একটি নাম শ্রুতি। ঋষি মুখ নিঃসৃত সিদ্ধ বাণীর নাম আপ্তবাক্য; আপ্তবাক্য বেদব্ৎ প্রামাণ্য। শ্রুতি দ্বিবিধ- বেদ ও তন্ত্র (মনু-কুলুকভট্ট)। বেদতত্ত্বে অধিকার মাত্র ত্রিবর্ণের, মানব মাত্রই অধিকার তন্ত্র সাধনায়, এই মাত্র প্রভেদ। উপনিষদের ব্রহ্মণ, আত্মন ও তন্ত্রের শক্তি শব্দগুলির ন্যায় ব্যাপক অর্থের শব্দ কোন ভাষাতে নেই। মোক্ষমূলার সাহেবের মতে, ব্রহ্মণ ও আত্মন শব্দদ্বয় বহু প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার প্রাগৃঐতিহাসিক স্তরের, তার মতে, ব্রহ্মণ শব্দের আদি ধাতু জানা না থাকলেও ব্রহ্মণ শব্দের গোড়ার অর্থ=যা স্ফুটীকৃত হয়, ভেঙ্গে পড়ে, তা সে চিন্তার আকারেই হোক, বাক্যের আকারেই হোক অথবা স্বজনী শক্তির আকারেই হোক বা দৈহিক বলের আকারেই হোক।
[(উক্ত সাহেবের The Vedanta Philosophy দ্রঃ)। সাহেব দেখাচ্ছেন যে, বৃহ, বৃধ্=বর্দ্ধনার্থ, বৃধ, বদ্ধ= Latın Verbum, Latınaএ ‘ধ’ স্থানে ‘ফ’ বা ‘ব’ উচ্চারিত হয়, তা হলে রুধির= Rufees বা Ruber-ইং, Red, যখন ‘ধ’ স্থানে ইংরাজিতে ‘দ’ হয়, তখন ‘বর্দ্ধ’ = Word। অর্থাৎ ‘ব্রহ্মণ’, ‘Verbum’, ‘Word-সবই ঐ ‘বৃহ’ বা ‘বৃধ্’ ধাতু হাতে এসেছে ও একই অর্থ প্রকাশ করে।]
সাহেব আরো বলেছেন যে ব্রহ্মণ শব্দ হতে ক্রমশঃ ভারতীয় আর্যের মধ্যে সর্বপ্রথম আসে bursting forth of the world, বিশ্ব স্ফুটিকৃত হয়েছে-এই ভাব, যার পরিণতি। স্ফোট বাদ- বাক্ এর স্ফুট্। বহু বহু পরে Alexandrian School এর ভেতর অনুরূপ ভাব প্রস্ফুটিত হয়েছে দেখা যায়। মোক্ষামূলার সাহেব বলেন যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে, উভয় জাতিই স্বাধীন চিন্তার ফলে একই তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, কেউ কারও কাছে ঋণী নন। ভারতের বেলায় পাশ্চাত্যের স্বাধীন চিন্তাও সংকুচিত হয়ে যায়! একই তত্ত্ব যে বিভিন্ন দেশে দেখা যেতে পারে না, তা নয়; কিন্তু যে দেশে একটি নতুন চিন্তা ওঠে, সেটি ঐ দেশের আবেষ্টনী ও ভাবধারার ফল, অন্যত্র যদি অনুরূপ ভাবধারার সৃষ্টি হয়, তবেই সে দেশে ঐ রকম মৌলিক চিন্তা দেখা দিতে পারে, যদি বিপরীত ভাবধারা হয়, একই রকম তত্ত্ব আবিষ্কৃত হতে পারে না। যিশুর ভাব যিশুর দেশে ছিল না, কিন্তু তাঁর জীবন গঠিত হয় অন্য এক আবেষ্টনীর মধ্যে, যেখানে তাঁর পরবর্তী জীবনের অনুকূল ভাবধারার সৃষ্টি হয়েছিল। মোক্ষামূলার সাহেব নিজেই প্রমাণ করেছেন যে, Socrates অন্ততঃ একজন ভারতীয়ের সঙ্গে ঈশ্বরতত্ত্ব সম্বন্ধে বাদানুবাদ করেছিলেন, যে ভারতের সঙ্গে গ্রীসের সাক্ষাৎ ও পরোক্ষ সম্বন্ধ (পারসীকদের বা জরথুষ্ট্রবাদীদের মধ্য দিয়ে) স্থাপিত হয়েছিল সক্রেটিসের পূর্বে (Theosophical or Psychological Religion. Lecture III-Maxmuller দ্রঃ), আর ঐ ভাবধারার অর্থাৎ ভারতের ভাবধারার সম্পর্কে আসার পরে Alexandrian School এর উদয় গ্রীসে সম্ভব হয়েছিল। এ বিষয়ে পরে আমরা আরো ভাল করে বুঝতে চেষ্টা করব। Socrates এর জীবন গ্রীসে নতুন প্রাণ এনে দেয়; তিনি ছিলেন আত্মজ্ঞ পুরুষ। দুই বিবাহ সত্ত্বেও তাঁর নিষ্কাম ও নিস্পৃহ জীবন আজও সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। গ্রীসে ওরকম ভাব আসে কোথা হতে, যে দেশের শিল্প কলাও (Hellenic Art) কামভাবোদ্দীপক ও আচার বিলাস পঙ্কিল? অধুনা বহু মনীষি সক্রেটিসকে বেদান্তী বলে মনে করেন। সক্রেটিস যে ভাবধারা প্রবর্তন করেছিলেন, গ্রীস তা গ্রহণ করতে পারেনি, ধরে রাখতেও পারেনি! ভারতে শক্তিগঠনের মূল ভাব ব্রহ্মচর্য, তা অন্যত্র কোথায়? ভারতের ভাব অন্যত্র গেছে কিন্তু ভাবকে ধরে রাখতে গেলে ভারত যে উপায় অবলম্বন করেন, অন্যত্র কেউ সে দিক্ দিয়ে যান নি। প্রত্যেক নতুন ভাব গ্রহণের পূর্বে ভারতে একটি সংস্কার নিতে হত। অর্থাৎ ভাব গ্রহণে অধিকারী হবার জন্য সাধনার দ্বারা সেই ভাবকে একটি সংস্কারে পরিণত করা হত, যাতে জীবন পবিত্র ভাবে গঠিত হয়। এমন কি, ব্যাকরণ আদি পড়ার পূর্বেও, একটি সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। ভাষাতত্ত্বের দিক দিয়ে আর্য আর্য বলে চেচাঁলেই হয় না। ভারতের ন্যায় অনেক জাতিও গরুকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করেছে, কিন্তু ভারতে যজ্ঞাদিতে দুধ ঘি এর। অপর্যাপ্ত ব্যবহার হত, আর্যেরা দুধের গুণ জানতেন। ভারতে দুহিতাই ঘরে ঘরে গো-দোহন করত, কিন্তু ঈজিপ্টে, গ্রীসে বা রোমে কোথাও গো দোহনের রীতিও ছিল না। ভাব গেছে, আচারও ছিল না আর্যের মত।
গোড়া থেকেই ভারত অতীন্দ্রিয় জ্ঞান লাভকে জীবনের আদর্শ করেছেন। পাশ্চত্য মনীষিরা এটা বুঝতে না পেরে ভারতের ইতিহাসে ভাবসঙ্কট উপস্থিত করেছেন। আপ্ত বাক্য সম্যক্দর্শন (সাক্ষাৎকার), অমরত্ব এই শব্দগুলিতে কি বুঝায়? মন্ত্র দ্রষ্টার সিদ্ধান্ত বাক্যই আপ্তবাক্য।
[আপ্নোতি, পাওয়া হওয়া ও হয়ে যাওয়াই-Being and Becoming = সৎ ও সম্ভূতি = লাভ
“প্রতিরোধ বিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে।
আত্মনা বিন্দতে বীর্য্যং বিদ্যয়া বিন্দতেহমৃতম্।।” কেন।]
প্রতিরোধবিদতই মত বা জ্ঞান। প্রতিরোধ= বোধে বোধ, প্রত্যেক বোধের (প্রত্যয় বা বুদ্ধিবৃত্তির) বোধ। বোধে বোধই মত, এটাই জ্ঞান, এটাই সাক্ষাৎকার বা সম্যক্দর্শন, প্রত্যেক বোধ কেন্দ্রীভূত হয়ে প্রকাশিত হওয়াই সম্যক দর্শন (তৎমত)। এটাই সমস্ত বোধের বা প্রত্যয় সমূহের প্রত্যাগাত্মরূপ বা ব্রহ্মের প্রকাশকরূপ। এই যে আত্মা (জ্ঞান), এর দ্বারাই বীর্যলাভ হয়, অন্য কোন শক্তি বা উপায় দ্বারা মৃত্যুকে জয় করা যায় না, যথার্থ বীর্য লাভ হয় না-আত্মজ্ঞান দ্বারাই মৃত্যু অভিভূত হয়; সুতরাং এই আত্মজ্ঞান রূপ বিদ্যাই অমরত্ব আনায়। মত মানে অনুভূতি লব্ধ জ্ঞান। ঋষি বা মন্ত্রদ্রষ্টার অর্থ ও আমরা বুঝতে পারি এইখানে।
[কৈয়ট বলেন, বুদ্ধি প্রতিভাস= “যদা যদা শব্দ উচ্চাবিস্তদা তদর্থকারা বুদ্ধিরূপজায়তে ইতি প্রবাহ নিত্যত্বাদর্থস্য নিত্যনীত্যর্থঃ’ (মহাভাষ্য)। অর্থাৎ শব্দার্থ বুদ্ধির প্রতিভাসক, যখনই শব্দ উচ্চারিত হয়, তখনই অর্থাকারা বুদ্ধি জন্মায়, এই প্রকার নিত্যতা বশতঃ অর্থের নিত্যতা, সুতরাং অর্থ বোধরূপা বাক্য ও নিত্য। এই নিত্য, জগতের দিক্ দিয়ে। ইঙ্গিতেও মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, কিন্তু উচ্চ চিন্তার জন্য বর্ণাত্মক ভাষার সাহায্য অত্যাবশ্যক।]
ঐ বোধে বোধ আনার জন্যই সাধকের আর্তি। ভক্তির দিক দিয়ে বাঙ্গালী বৈষ্ণব কবি বোধে বোধ টি প্রস্ফুটিত করেছেন তাঁর আর্তিতে, ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর। প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।’
“যস্মিন সর্ব্বাণিভূতান্যাত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ।
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ। (‘ঈশ’)।
যার সমস্ত ভূত জগৎ আত্মাই হয়ে যায় (আত্মাএব অভূত) এবং সর্বভূতে আত্মার অনুদর্শন হওয়ায় ‘এক’ জ্ঞান(বিদ্যার) উদয় হয় (জানেন বা বুঝতে পারেন। -বিজানতা), তাঁর মোহই বা কি শোকই বা কি? এই অবস্থাপ্রাপ্ত মহাজনই আপ্ত, তাই আপ্তবাক্যকে অভ্রান্ত বলা হয়। ঐ বিদ্যার নামই ব্রহ্মবিদ্যা। এই ব্রহ্মবিদ্যার ধারা চলে আসছে ও এসেছে বরাবর গুরুপরম্পরায়, তাই বেদ, শ্রুতি নামে আখ্যাত। মনে রাখতে হবে যে বিদ্যা বা জ্ঞানই চলে আসত, মুখস্থ বা কণ্ঠস্থ বিদ্যা নয়। ভারতে বহু নিরক্ষর মহাপুরুষ জন্মেছেন, এটিও এই সঙ্গে মনে রাখতে হবে।
পাশ্চাত্যরা করেছেন এই খানে ভুল। পাশ্চাত্য বলেন যে, তখন লিপি ছিলনা তাই বেদবিদ্যা চলে এসেছে শুনে শুনে বংশ-পরম্পরায়। তাই বেদের নাম শ্রুতি। শুনে শুনে চলে আসতে পারে গান, হাতেনাতে চলে আসতে পারে বাজনা ও সুরতালের সংযোগে কণ্ঠস্থ হতে পারে। অসংখ্য কবিতা, কিন্তু বর্ণাত্মক ভাষা, অতবড় ভাষাত্মক বেদের শব্দরাশি চলে আসে বংশ পরম্পরায় কেমন করে লিপি বিনা? যদি এই মত সত্য হয়, তাহলে মানতে হবে যে, তখন লিখন প্রণালী না থাকলেও শব্দরাশি শেখান হত ঠিক, তবে শেখাবার রীতি ছিল স্বতন্ত্র, তা হলে স্বীকার করতে হয় যে, তখন এই জাতি অত্যদ্ভূত মেধাবী ছিল, তখন না লিখে পড়ে সব হত সংযমী ও ইন্দ্রিয়জয়ী, আর এখন? এখন লেখা পড়ার এত সরঞ্জাম ও সুবিধা সত্ত্বেও পশুত্ব ঘোচেনা, আমরা ঘরের কথাও ভাবতে অক্ষম। তখন দ্বিজাতির বিবাহই হত না বেদ অধ্যয়ন না করলে, ব্রহ্মচর্য ও গুরুগৃহবাস শেষে ঘরে না ফিরলে মূর্খের সমাজে স্থান হত না। কত সহজে তখন বিদ্যা অবশ্য শিক্ষণীয় রীতিতে পরিণত হয়েছিল! পাশ্চাত্য আরো বলেন যে তখন লিপি না থাকলেও ছিল ছন্দ, কিন্তু ছন্দ থাকলে কি হবে? ছন্দের কোন নিয়ম মেনে ঋষিনামধেয় ব্যক্তিরা চলেন নি, কোন নিয়মের বাঁধ তারা মানেন নি- বেদ যে চাষার গান-ঋষি তো কৃষক ছিলেনই। চাষার গানে যদি এই হয়, যার নমুনা অন্যত্র কোথাও নেই, তখনকার উন্নত শ্রেণীর লোকের বা জ্ঞান ছিল কেমন তাহলে?
অতীন্দ্রিয় বোধকে ভাষায় নানা ভাবে প্রকাশ করতে হলে যে সর্বপ্রকার নিয়মের শৃঙ্খলাকে অতিক্রম করতে হয, এটা অসম্ভব কিসে? বাঙ্গালীর কীর্তন কি স্বরলিপিতে সব ফেলা যায় আজও? এই সে দিনকার কথা, বাঙ্গালী জয়দেবের ‘প্রলয় পয়োধিজলে’ কবিতাটি কি ছন্দের কোন নিয়ম মেনেছে, ছন্দ বিধিকে কি অতিক্রম করে যায়নি? কষ্ট কল্পনা করে পণ্ডিতেরা সমস্ত গানটিকে ভেঙ্গে বিভিন্ন ছন্দে এক রকম করে দেখিয়েছেন।
[(পণ্ডিত চন্দ্রমোহন সংকলিত ‘ছন্দঃসার সংগ্রহ’ দ্রঃ)। ‘প্রলয়- পয়োধিজলে’ কবিতাটি সম্পূর্ণ তুলে তিনি বলছেন যে ওটি কি কোন ছন্দে লেখা? তার পরই বলছেন “The sweetness of its cadence and the regularity of its periods would at once indicate its place there …But where is to be placed?)
অর্থাৎ সুর মাধুর্য ও তালের কালিক নিয়মের নির্দিষ্টতায় নিশ্চয়ই এটার একটা স্থান নির্দেশ করা যায়, কিন্তু কোথায় এর স্থান দেওয়া যায়? তিনি বলছেন যে ঐ রচনাকে সমবৃত্রম, অর্দ্ধসমম, বিষমম্ পর্যায়ে ফেলা যায় না। তা হলে এই একটি জাতি? এটা কোন আর্যা ও নয়, বৈতালিয়ম বা তার প্রকারভেদ ও নয়, মাত্রাসমকানির অন্তর্গত করা যায় না। এইরূপে ছন্দ শাস্ত্রের কোন পর্য্যায়ে ফেলা যায় না, কিন্তু কানে বাজে যে ছন্দ? সুতরাং পণ্ডিতজি একটিকে অতিরিক্ত মাত্রা ছন্দ, অপরটিকে অনুষ্টিভতুঙ্গ, কোনটিকে বৃহত্যাং কমলা বা মাত্রাসমক, জগত্যাংতামব্স ইত্যাদি বিভিন্ন অংশে দেখিয়েছেন।
[ছন্দ শাস্ত্রানুসারে লঘুকর বর্গ= Pericles and Treacle, প্রামাণবর্গ=lambus) দুটি সূত্র (পিঙ্গলা বলেন)-গ্নিতি সমনী, ল্লিতি প্রমানী= Trochaic and Iambic measures, সমাবৃত্ত ছন্দ-Blank verse ইত্যাদি।]
এখানে এইমাত্র বললেই হবে যে বৈদিক ছন্দের পরিমাপ, মাত্রার দ্বারা নিয়মিত নয়। বৈদিক ছন্দকেও অপৌরূষেয় বলা হয়। পানিনীয় অষ্টাধ্যায়িতে ঋগ্বেদের ভাষাকে ছান্দম্ বলা হয়েছে ও সংস্কৃত বর্ণমালাকে মাহেশ্বরী সূত্র বলা হয়েছে; কারণ, ব্রহ্মা যেমন যোগতত্ত্বের আদি উপদেষ্টা।
শিবই সেরকম প্রথম সরল ধ্বনিকে অর্থযুক্ত সাঙ্কেতিক আকার দেন। বৈদিক ছন্দ কোন বিধি মেনে চলে নি, তার লক্ষ্য যেমন সর্বশৃঙ্খলার পারে, ছন্দের গতি ও সেই রকম অবাধ। যা অপৌরুষেয় নয় তাই লৌকিক ছন্দ (গণছন্দ, মাত্রাছন্দ, অক্ষর ছন্দ-বৃত্তম, জাতি বা মাত্রাছন্দ)। যাই হোক, বৈদিক মন্ত্র গুলিতে লঘুগুরু বর্ণবিন্যাস পদ্ধতি (metre) আছে। পাশ্চাত্য মতে, ঐ রকম ভঙ্গির জন্যই মন্ত্রগুলি শুনে শুনে চলে আসতে পেরেছে। চাষা ঋষি বেচারিদের তা হলে লঘুগুরু হিসাবে রচনার বুদ্ধিটুকু যুগিয়েছিল, আর বংশপরম্পরায় বিদ্যার ধারা রক্ষা করা দরকার, এ বুদ্ধিটিও ঘটে এসেছিল, যদিও ঋষি বা আচার্যকে অত শব্দরাশি লিপি বিনা শিষ্যদের কণ্ঠস্থ করাতে, কি দুর্ভোগই না পেতে হয়েছিল। বেদ অধ্যয়ন করতে হত, যখন লিপি ছিল না তখন অধ্যয়ন মানে শুধু আবৃত্তি। আর বারবার আবৃত্তি করাতে সব কণ্ঠস্থ হত ও এই রকমে বংশপরম্পরায় শুনে শুনে চলে আসত! ঋক্, ১ম, ১৭০ সূক্তের (‘ননূনমস্তি নো শ্বা..’) অনুবাদ দত্ত মহাশয় এরকম করেছেন, “অদ্যতন বা কল্যতন কিছুই নাই। অদ্ভুত কার্যের কথা কে বলতে পারে? অন্য লোকের মন অত্যন্ত চঞ্চল, যা উত্তমরূপে পাঠ করা যায় তাও ভুলে যাওয়া যায়।” পাঠ বা আবৃত্তি করাটা কি বিনা লিপিতে বা বিনা গ্রন্থে হত?
বেদ বলেন যে বেদপাঠ বা আবৃত্তি ও অপর বিদ্যা।
[“নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো, ম মেধয়া বহুধা শ্রুতেন” (কঠ ২য়/২৩)। প্রবচনেন = “অনেক বেদ স্বীকরণেন”]
তন্ত্রে ও বহু স্থানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে বহু শাস্ত্র আদি পাঠে কিছুই হয় না-জ্ঞানই একমাত্র মোক্ষের কারণ। অধ্যয়ন মাত্র আবৃত্তি নয়। ‘অধ্যয়নং চ স্বাধ্যায় সংস্কারঃ” (মহাভাষ্য)। স্বাধ্যায় বলতে বোঝায় বেদ। ‘স্বাধ্যায়ভ্যাসনঞ্চৈব বাঙ্ময়ং তপ উচ্যতে’ (গীত), বেদাভ্যাসই বাঙ্ময় তপস্যা। জ্ঞানি গৃহস্থ সর্বদা বাক্যে প্রাণবায়ু ও প্রাণে বাক্য আহুতি দেন।
[কথা বলবার সময়= “বাচি প্রাণং জুহোমি”, চুপ করে থাকলে= “প্রাণে বাচং জুহোমি”- (মনু ৪/২৩/২৪)]
বেদের সংস্কার কার্যই অধ্যয়ন। বেদজ্ঞান লাভ করবার জন্যই পুরুষার্থ চতুষ্টয়- ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ ও সাধন চাই, অর্থাৎ বেদজ্ঞানরূপ ভিত্তির উপরেই পুরুষার্থ দণ্ডায়মান। বেদের দ্বারা সাধন হয় বলেই, অধ্যয়ন দ্বারাই বেদের সংস্কার্য্য সিদ্ধ হয়। এই অধ্যয়নের সাক্ষাৎ ফল, বেদ-রূপ বর্ণরাশির স্বরূপ জ্ঞান, যাতে বিদ্যার স্ফুর্তি হয়। অনুষ্ঠানাদিতেও (কর্মকাণ্ডে) অর্থ বোধ চাই। চার রকমে বিদ্যার স্ফুর্তি হয়, (১) ‘আগম কালেন’-বেদবিদ্যা গ্রহণ কাল দ্বারা, (২) ‘স্বাধ্যায় কালেন’-অভ্যাস কাল দ্বারা, (৩) ‘প্রবচন কালেন’-অধ্যাপন কাল দ্বারা, (৪) ‘ব্যবহার কালেন’-প্রয়োগ কাল দ্বারা। এই যে প্রথা, এটা কি বংশপরম্পরায় বা গুরুপরম্পরায় চলে আসতে পারে না ? লিপি সম্বন্ধে প্রশ্ন ওঠে কেন ? জড়-বিজ্ঞান শাস্ত্র (Science) বুঝতে গেলে শুধু বই পড়ে হয় না, গুরুর কাছে বিদ্যা নিতে হয়, লেকচার কানে শুনতে হয়, হাতেনাতে অভ্যাস করতে হয়, অপরকে বোঝাবার মত স্পষ্ট ধারণা আনতে হয়, প্রয়োগ বা ব্যবহার জানতে হয়। গুরু বা আচার্য মুখে শুনে বোঝাকে আয়ত্তীকরণকে কি শ্রুতি বলা অসঙ্গত?
বেদে ছন্দ আছে, লঘুগুরু স্বরক্রম আছে, সাম গীত হয়, অতএব তখন সঙ্গীতবিদ্যা ও ছিল। প্রথম গানই সামগান। ব্রহ্মা হতে আসে বেদ তত্ত্ব বাক্ স্ফুটিত হয় প্রথম ব্রহ্মার মুখ হতে, শব্দের প্রকাশ হয়। শব্দ চার রকম- দ্রব্য, গুণ, ক্রিয়া, জাতি-যার মূল স্থানের নাম শব্দব্রহ্ম; তাই শব্দব্রহ্মের প্রকাশমুখ চার; ব্রহ্মার চার বদন- পুরাণস্য কবেঃ চতুর্ম্মুখ সমীবিতং…, তাই ব্রহ্মার শক্তি ‘বাক্দেবী’, তাই অধ্যয়নই ব্রহ্মযজ্ঞ।
[শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, এই যে ব্রহ্মযজ্ঞ, বাক্যই এই যজ্ঞের জুহূ, মন এর উপভৃৎ(ভরণ করা), চক্ষু এর ধ্রুবা, মেধা এর স্রুব, সত্যই এর অবভৃথ স্নান, স্বর্গলোক এর উদয়ন বা সমাপ্তি। ঋগ্ মন্ত্র এই যজ্ঞের ক্ষীরাহুতি, যর্জুমন্ত্র এর সোমাহুতি, অথর্ব্বাঙ্গিরস এর মেদাহুতি, পুরাণ ইতিহাস আদি এর মধুহুতি।’ (যজ্ঞকথা-রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী দ্রঃ)]।
আর্যপ্রভা এর লেখা সমূহ পড়ে আপনার মন্তব্য জানাবেন।
সৌজন্যে: সনাতন ধর্মতত্ত্ব ব্লগ সাইট ।
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।