উৎখাত পরিবারের জীবন-সমস্যাঃ
ধ্বংস্তূপের পর নোয়াখালিপ্রসঙ্গের দ্বিতীয় বেদনাদায়ক স্মৃতি উৎখাতদিগের দুর্বহ জীবন-সমস্যা। স্ব স্ব গৃহ ও গ্রাম হইতে উৎসন্ন হইয়া যে অগণিত নরনারী ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহাদের রক্ষা করিবার কি হইবে? রিলিফ কেন্দ্রে যাহারা একটু মাথা খুঁজিবার ঠাঁই পাইয়াছে, তাহাদের জীবন রক্ষার তবু কিছু ভরসা আছে। কিন্তু যাহাদের তাহা জোটে নাই, যাহারা শূন্যস্থানে, রেলষ্টেশনে এবং তাহাতেও স্থান না পাইয়া উন্মুক্ত নদীবক্ষে নৌকায় আশ্রয় লইয়াছে, তাহাদের ভরসা কি? বিশেষতঃ এই শীতকালে? নিম্নে সিক্তভূমি, উপরে মুক্ত আকাশ এবং চতুর্দিকে অবাধ হিমতীক্ষ্ণ বায়ু—এই অবস্থার মধ্যে মানুষ এমনিই বাঁচে না; যাহারা কিছুকাল পূৰ্বেও সম্পন্ন গৃহস্থের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল, তাহারা অকস্মাৎ উৎখাত হইয়া শিশুবৃদ্ধস্ত্রীলোকসহ যে ক্লেশ ভোগ করিয়াছে, তাহার চিন্তাও দুঃসহ। সম্পন্ন অবস্থা হইতে যাহারা সহসা পথে বসিয়াছে তাহারা ছাড়া আরও অনেকের পক্ষেই যে জীবনরক্ষা করা সম্ভব হইবে না তাহা ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে।
আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়াছেঃ
সুতরাং হয় ধর্মান্তর না হয় মৃত্যু—এই দুই বিকল্প সম্মুখে রাখিয়া অভিযানে বাহির হইয়া যাহারা এতগুলি লোককে উৎখাত করিয়াছে, তাহাদের উদ্দেশ্য প্রকারান্তরে সিদ্ধ হইয়াছে বৈ কি? ধৰ্ম্মান্তর বা অপঘাতের সম্ভাবনা উৎখাতগণ এড়াইয়াছে বটে; কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনা ইহাদের উপর ছায়া ফেলিয়াছে। রিলিফ কেন্দ্রের আশ্রয়েই হউক বা উন্মুক্ত স্থানেই হউক, যেভাবে ইহাদিগকে জীবন কাটাইতে হইতেছে তাহা শারীরিক বা মানসিক কোনো প্রকার স্বাস্থ্যের পক্ষেই কল্যাণজনক নহে। গৃহ-পরিবেশ হইতে ও সামাজিক জীবন হইতে এইভাবে বিচ্ছিন্ন হইয়া লোকে বহুদিন টিকিয়া থাকিতে পারে না।
নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলার রিলিফ ক্যাম্প ছাড়া চাঁদপুর, আখাউড়া, চৌমুহনী প্রভৃতি ষ্টেশনের প্লাটফর্মেও উৎখাত-সমাবেশ লক্ষ্য করিয়াছি। চাঁদপুর ষ্টেশনে উহা উপনিবেশে পরিণত হইয়াছে বলিলেও চলে। কোনো কোনো রিলিফ ক্যাম্পের অবস্থা যাহা দেখিয়াছি এবং সরকারী রিলিফ সম্বন্ধে যে সকল সংবাদ পাইয়াছি, তাহাতে ষ্টেশন-আশ্রয়ী জনতার কথা আর উঠাইতে ইচ্ছা হয় না। কুমিল্লার কর্মীরা স্থানীয় বিদ্যাভবনসমূহে যে কয়টি রিলিফ ক্যাম্প খুলিয়াছেন তাহাতে তাঁহারা যথাসাধ্য সুব্যবস্থা করিয়াছেন সন্দেহ নাই। কিন্তু মনুষ্যজীবন রক্ষার জন্য আরও যথেষ্ট বন্দোবস্ত করা প্রয়োজন এবং সে বন্দোবস্ত নির্ভর করে সরকারী সাহায্য, সুব্যবস্থা ও মনোযোগিতার উপর।
আশ্রয়প্রার্থি-নিবাসের অব্যবস্থাঃ
বিভিন্ন উৎখাত-নিবাসের যে সকল সংবাদ পাইয়াছি তাহাতে দুইটা অভাব ও অব্যবস্থা বিশেষভাবে দুঃখের সহিত লক্ষ্য করিয়াছিঃ— ঔষধ-পথ্য ও চিকিৎসকের অভাব এবং প্রসূতি ও সদ্যোজাত শিশুদের উপযুক্ত রক্ষণব্যবস্থার একান্ত অভাব। একে স্বাস্থ্যরক্ষার অত্যন্ত প্রাথমিক ব্যবস্থারও অভাব, তাহার উপর উপযুক্ত ঔষধের অভাব; সকল উৎখাত-উপনিবেশের ইহা সাধারণ অভিযোগ। রামগঞ্জে যাইতে পথের দুই দিকের রিলিফ ক্যাম্প হইতে যে উৎকট দুর্গন্ধ আসিতেছিল তাহাতেই বুঝিলাম স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার নিতান্তই অভাব। আমিষাপাড়া যাইবার দিন আমাদের পৌঁছিতে সন্ধ্যা হইয়া যায়; রাত্রিতে ফিরিতে পারি নাই—রিলিফ ক্যাম্পে রাত্রি কাটাইতে হইয়াছিল। আশ্রয়প্রার্থীদের সহিত একরাত্রি কাটাইয়া দেখিলাম, শিশু হইতে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রত্যেকেই সর্দি-কাসিতে বিশেষ ভুগিতেছে। নিউমোনিয়া এবং ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া রিলিফ ক্যাম্পের সাধারণ ব্যাধি, তাহার উপর উদরাময়। ফরিদগঞ্জে হাসপাতাল-নামধেয় একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হইয়াছে বটে; কিন্তু ৭০০০ আশ্রয়প্রার্থীর জন্য প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালের তত্ত্বাবধান করিতে একটি সদ্য পাশ করা এল-এম-এফ ডাক্তার নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ইহাতেই হাসপাতালের স্বরূপ উপলব্ধি হইবে। উৎখাত ও আশ্রয়প্রার্থিগণ যে, সম্প্রদায়ভুক্ত তাহাদের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসকের অভাব নাই; তথাপি কেন জানি না গবর্ণমেণ্ট বাছিয়া বাছিয়া ভিন্ন সম্প্রদায়ের এই এল-এম-এফ ডাক্তারটির উপরেই এই গুরুতর দায়িত্ব ন্যস্ত করিয়াছিলেন। চিকিৎসকমহলের সংবাদে জানিতে পারিয়াছিলাম যে স্থানীয় অবস্থা এমনই যে, এপেন্ডিক্স-শূলবেদনায় আক্রান্ত একটি রোগীর জন্য একটি মরফিন ইনজেকসন সংগ্রহ করিতে পারা যায় নাই।
আসন্নপ্রসবা ও সদ্যপ্রসূত নারীঃ
নোয়াখালি হইতে এই সমাজগত উচ্ছেদে আসন্নপ্রসবা নারীরা যে ক্লেশ পাইয়াছে, সে মৰ্ম্মবিদারী কাহিনী কখনও প্রকাশিত হইবে না। রেলগাড়ীর কামরায়—রেল-ষ্টেশনের প্লাটফর্মে প্রসববেদনায় কাতর ও সদ্যপ্রসূতা নারীদের অবস্থার কল্পনাই যথেষ্ট। আশ্রয়প্রার্থি-নিবাসের ভূমিশয্যায় থাকিয়াও ঔষধপথ্যের অভাবে সদ্যোজাত শিশুদের জীবন গিয়াছে এবং যখন এই সংবাদ পাইয়াছি তৎকালীন অবস্থায় সদ্যপ্রসূতা জননীরা মৃত্যুর পথে আগাইতেছেন। ২১শে নভেম্বর তারিখে ফরিদগঞ্জ অঞ্চলের সংবাদে জানিতে পারি, পূর্ববর্তী ১২ দিনের মধ্যে দুইশতাধিক শিশু জন্মিয়াছে—শিশুগুলি সবই মারা গিয়াছে এবং বিশেষ ব্যবস্থা না করিলে জননীদের বাঁচাইবার সম্ভাবনা অল্পই।
[বাঙলা গভর্ণমেন্টের প্রচারবিভাগ ইহার প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদটি এই :-
“গত ১৬ই ডিসেম্বর তারিখের ‘আনন্দবাজার পত্রিকায়’ প্রকাশিত ‘নোয়াখালীর ধ্বংসকাণ্ড’ শীর্ষক প্রবন্ধে শ্ৰীযুত চপলাকান্ত ভট্টাচাৰ্য লিখিয়াছেন যে, গত ৯ই নভেম্বর হইতে ২১শে নভেম্বরের মধ্যে ফরিদগঞ্জে দুই শতাধিক শিশু জন্মগ্রহণ করিয়াছে এবং প্রত্যেকটি নবজাত শিশুই মারা গিয়াছে। এ ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা হইয়াছে। চাঁদপুর ক্যাম্প হইতে জনস্বাস্থ্য বিভাগের স্পেশাল এ্যাসিষ্ট্যান্ট ডিরেক্টর জানাইয়াছেন যে, প্রবন্ধে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে ফরিদগঞ্জ এলাকায় মাত্র ১৮টি শিশু জন্মগ্রহণ করিয়াছে। তন্মধ্যে মাত্র দুইটি শিশু ও একজন প্রসূতি মারা গিয়াছে।
ইতি বশম্বদ পি, এস, মাথুর, বাঙলা সরকারের প্রচার বিভাগের ডিরেক্টর”
—আনন্দবাজার পত্রিকা, সহর সংস্করণ, ১৩ই জানুয়ারী, ১৯৪৭।
[বাঙলা গভর্ণমেন্টের প্রচারবিভাগ ইহার প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদটি এই :-
“গত ১৬ই ডিসেম্বর তারিখের ‘আনন্দবাজার পত্রিকায়’ প্রকাশিত ‘নোয়াখালীর ধ্বংসকাণ্ড’ শীর্ষক প্রবন্ধে শ্ৰীযুত চপলাকান্ত ভট্টাচাৰ্য লিখিয়াছেন যে, গত ৯ই নভেম্বর হইতে ২১শে নভেম্বরের মধ্যে ফরিদগঞ্জে দুই শতাধিক শিশু জন্মগ্রহণ করিয়াছে এবং প্রত্যেকটি নবজাত শিশুই মারা গিয়াছে। এ ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা হইয়াছে। চাঁদপুর ক্যাম্প হইতে জনস্বাস্থ্য বিভাগের স্পেশাল এ্যাসিষ্ট্যান্ট ডিরেক্টর জানাইয়াছেন যে, প্রবন্ধে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে ফরিদগঞ্জ এলাকায় মাত্র ১৮টি শিশু জন্মগ্রহণ করিয়াছে। তন্মধ্যে মাত্র দুইটি শিশু ও একজন প্রসূতি মারা গিয়াছে।
ইতি বশম্বদ পি, এস, মাথুর, বাঙলা সরকারের প্রচার বিভাগের ডিরেক্টর”
—আনন্দবাজার পত্রিকা, সহর সংস্করণ, ১৩ই জানুয়ারী, ১৯৪৭।
এই প্রতিবাদ সম্বন্ধে দুইটী বক্তব্য আছে; প্রথম, ফরিদগঞ্জ আশ্রয়প্রার্থি-হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যাপারের সহিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট হইতেই আমার বিবরণ তৎকালে সংগৃহীত এবং দ্বিতীয়, নোয়াখালির ধ্বংসকাণ্ডের আলোচনায় প্রকাশিত বিবরণসমূহের মধ্যে মাত্র এই একটি ক্ষেত্রেই সরকারী প্রতিবাদ পাওয়া গিয়াছে।]
যাহা সাধারণ মানুষেরও খাদ্য হইবার উপযোগী নহে, সদ্যপ্রসূতা জননীদের সেই খাদ্যের উপর নির্ভর করিতে হইয়াছে। ভূমি শয্যা, অনাচ্ছন্ন গৃহ, ঔষধপথ্য নাই, স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা দূরের কথা, ব্লিচিং পাউডার পর্যন্ত নাই—তাহার উপর আহারের জন্য “Broken Rice” নাম দিয়া খুদ সরবরাহ-ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল যাহা হইতে পারে তাহাই হইয়াছে।
উৎখাত ও আশ্রয়প্রার্থীদিগের এই ক্লেশকর জীবন লক্ষ্য করিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায়, নিতান্ত বিপন্ন না হইলে ইহারা আসে নাই। বহুপুরুষের বাস্তব্য বাসভূমি ও বহুপরিচিত আবেষ্টন ছাড়িয়া ইহারা অকস্মাৎ চলিয়া আসিয়াছে কোন অনিশ্চিত সাহায্যের আশায়। কোথায় যাইবে জানে না—কে সাহায্য করিবে জানে না—আহারের অভাবে ও চিকিৎসার অভাবে মরিবে, তথাপি চলিয়া আসিয়াছে। ইহাদের মত অসহায় সংসারে কেহ আছে কি না সন্দেহ। গবর্ণমেন্টপক্ষীয় ব্যক্তিরা যখন বলেন, ইহারা “প্যানিকে” (আতঙ্কে) চলিয়া আসিয়াছে, তখন তাহা ইহাদের অসহায়তার প্রতি পরিহাস বলিয়াই মনে হয়। এক “প্যানিক” কথাটি চালাইয়া গবর্নমেন্ট দুইটা গুরুতর দায়িত্ব এড়াইতে চাহিতেছেন—যে কারণে ইহারা চলিয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছে তাহার দায়িত্ব এবং চলিয়া আসিবার পর ইহাদের পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বলিয়া ইতিপূর্বে যে সকল ঘটনা ঘটিয়াছে তাহাতে উৎখাত ও ও আশ্রয়প্রার্থি-সমস্যা দেখা দেয় নাই। কিন্তু গত ১৬ই আগষ্ট তারিখে কলিকাতায় মুসলিম লীগের “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম” অনুষ্ঠানের সময় হইতেই এই সমস্যা দেখা দিয়াছে—ইহাই বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয়। এই একটি বিষয় তলাইয়া দেখিলেই গবর্ণমেন্ট ইহার হেতু ও স্বরূপ বুঝিতে পারিবেন। আসল কথা এবারে লোকে গবর্ণমেন্টের উপর আস্থা হারাইয়া ফেলিয়াছে। উৎখাত ও আশ্রয়প্রার্থী-সমস্যা তাহারই পরিণাম; মাত্র “প্যানিকের” অজুহাত দেখাইয়া গবর্ণমেণ্টপক্ষীয়গণ ইহা চাপা দিতে পরিবেন না বা আপনাদের দায়িত্ব এড়াইতে পারিবেন না।
রিলিফ বিতরণে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতঃ
বিহার হইতে আনীত সম্প্রদায়বিশেষের আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য বাঙলা গবর্নমেন্ট যাহা করিতেছেন তাহার সহিত নোয়াখালি-ত্রিপুরার উৎখাত গণের প্রতি তাঁহাদের ব্যবহার তুলনা করিয়া লজ্জাবোধ করিতেছি। আসানসোল অঞ্চলে আনীত বিহারী আশ্রয়প্রার্থীদের খাদ্যাদির ব্যবস্থা যাহা শুনিতে পাই তাহার সহিত নোয়াখালি-ত্রিপুরার উৎখাতগণের খাদ্যব্যবস্থার তুলনা গ্লানিজনক। বিহারের উৎখাতগণের জন্য বিহার, গবর্ণমেন্ট যে পরিমাণ খাদ্য বরাদ্দ করিয়াছেন, পূর্ব বাঙলার উৎখাতগণের জন্য বাঙলা গবর্ণমেন্টের বরাদ্দ তাহা অপেক্ষাও কম। এই কম বরাদ্দও বাঙলা গবর্ণমেন্টের কৰ্ম্মনীতি এবং স্থানীয় কর্মচারীদের ব্যবস্থার ফলে উৎখাত গণের নিকট সম্পূর্ণভাবে পৌঁছায় নাই। উৎখাত হইল এক-সম্প্রদায়, কিন্তু গবর্ণমেন্টের ব্যবস্থা হইল অন্য-সম্প্রদায়কেও রিলিফের রেশন দিতে হইবে এবং বাছিয়া বাছিয়া এই অনুগৃহীত সম্প্রদায়ের কর্মচারীকেই রেশন সরবরাহের কাৰ্যে নিযুক্ত করা হইল। স্থানীয় প্রধান প্রধান শাসনকর্মচারীও নিযুক্ত হইয়াছেন এই একই সম্প্রদায় হইতে আর তাহারাও বাছিয়া বাছিয়া স্বসম্প্রদায়ভুক্ত ইউনিয়ন বোর্ড প্রেসিডেন্টের মারফতে রেশন বিলির ব্যবস্থা করিলেন এবং উৎখাতগণ যখন সহরের দিকে চলিয়া আসিয়াছে তখন মফস্বলে রিলিফের দ্রব্যাদি বিতরণের নির্দেশ দিলেন। ফলে যাহারা সত্য সত্য উপদ্রুত ও উৎখাত হইল, তাহারা রিলিফ বরাদ্দের একাংশ মাত্র পাইল, অপরাংশ এবং হয়তো বা অধিকাংশই চলিয়া গেল তাহাদেরই হাতে যাহারা উৎখাতগণের গৃহত্যাগের জন্য দায়ী এবং তারা পূৰ্বেই এক দফা লাভবান হইয়াছে। শেষোক্তগণের মধ্যে রিলিফ বিতরণের যৌক্তিকতাসম্বন্ধে প্রশ্ন করিয়া শুনিয়াছি, ইহাদের মধ্যে অনেকে উপদ্রবঘটিত অভিযোগে গ্রেপ্তার হইয়াছে তাহাদের পরিবারও অসহায়, সুতরাং সাহায্য পাইবার যোগ্য। জানি না, বাঙলা গবর্ণমেন্ট গোপনে এই নীতি গ্রহণ করিয়াছেন কিনা যে, গুরুতর অপরাধের অভিযোগে যাহাদের গ্রেপ্তার করা হইবে, তাহাদের পরিবার সরকারী তহবিল হইতে সাহায্য পাইবার যোগ্য বলিয়া পরিগণিত হইবে। যদি গবর্ণমেন্ট এই নীতি গ্রহণ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে অপরাধ দমনের পক্ষে ইহা যে অত্যন্ত অনুকূল নীতি তাহাতে সন্দেহ কি!!
উৎখাত সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত রিলিফ দ্রব্যাদি অন্য সম্প্রদায়ের নিকট যে চলিয়া যাইতেছে, তাহার দৃষ্টান্ত ও প্রমাণস্বরূপ স্থানীয় ব্যক্তিরা ত্রিপুরা জেলার হাজিগঞ্জ ও পাইকপাড়া অঞ্চলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছিলেন। হাইমচরের উৎপীড়িতগণ বিশেষভাবে আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন যে, তাহারা কেরোসিন একদম পাইতেছেন না। কোন বিশিষ্ট সংবাদদাতা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলেন, চাঁদপুর মহকুমায় সরবরাহ করা রিলিফের দুই-তৃতীয়াংশই এইভাবে উৎখাতগণকে না দিয়া অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতরিত হইয়াছে। বাঙলা গবর্নমেন্ট কর্তৃক সমরবিভাগ হইতে সংগৃহীত প্রায় ১০০০ উৎকৃষ্ট কম্বল চাঁদপুরের মহকুমা হাকিম, “খাঁ মহাশয়” [মৌলবী আফতাব আহম্মদ খাঁ] যেভাবে বিলি করিয়াছেন- তাহার সম্পূর্ণ বিবরণ উদঘাটিত হইলেই এ বিষয়ে অনেক তথ্য জানা যাইবে। অপর একজন সংবাদদাতার নিকট শুনিলাম, এই চাঁদপুর মহকুমাতেই কোন কোন আশ্রয়প্রার্থিনিবাসে ভূমিশায়ী উৎখাতগণের জন্য কম্বলের ফরমাইস করা হইলে, সরকার হইতে কম্বল প্রেরণের সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দেওয়া হইল যে, মফঃস্বলের জন্যও এই কম্বল দিতে হইবে। উৎখাতগণ তখন মফঃস্বল হইতে সরিয়া আসিয়াছে, যাহারা তাহাদিগকে উৎখাত করিয়াছিল মফঃস্বলে রহিয়াছে তাহারাই। সুতরাং এই নির্দেশের ফলে প্রেরিত ৫০০ কম্বলের মধ্যে ২০০ মফঃস্বল রিলিফের নামে অন্য সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যে চলিয়া গেল—উৎখাতগণের অনেকে যেমন ছিল তেমনি মাটীতেই রহিল।
কেবল মফঃস্বলে পাঠাইয়াই শেষ নাই। চাঁদপুর সহরেরও এক প্রান্তে দেখিলাম, এই অনুগৃহীত সম্প্রদায়ের জন্য এক আশ্রয়প্রার্থিনিবাস খোলা হইয়াছে এবং পাকিস্থানমার্কা টুপী পরিহিত এক ব্যক্তি যষ্টিহস্তে তাহার প্রায়বরুদ্ধ প্রবেশপথে পাহারা দিতেছে। কিছু কিছু লোকও ভিতরে আছে সত্য। কে ইহাদের উপর উপদ্রব করিল, কোথা হইতে ইহারা উৎখাত হইয়া আসিল জানিবার জন্য দ্বারপালটীকে কয়েকবার প্রশ্ন করিলাম—বিশেষ সদুত্তর পাইলাম না; অতিরিক্ত প্রশ্ন করিতেও ভরসা হইল না। সহরের মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম, এই রিলিফ কেন্দ্রের আশ্রিতগুলি সহর হইতেই সংগৃহীত। যাহারা পূর্ব্বে পথে অন্ন সংগ্রহ করিত, তাহারা এখন ঘরে বসিয়া অন্ন পাইতেছে এবং সহরে আশ্রিত উৎখাতদিগের জন্য বরাদ্দ রিলিফের একটা অংশ এই দিকে যাইতেছে।
উৎখাত-বিতাড়নঃ
একদিকে এই ব্যাপার চলিতেছে—অপরদিকে যাহারা প্রকৃতই আশ্রয়হীন ও উৎখাত, তাহাদিগের উপর গবর্ণমেন্টের হুমকী চলিতেছে, চলিয়া যাও নহে তো রেশন বন্ধ করিয়া দিব। গবর্ণমেন্ট মাত্র এই হুমকী দিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, ইহা কাৰ্য্যেও পরিণত করিয়াছেন যদিও সে সংবাদ সংবাদপত্রের নিকট পৌছায় নাই। চাঁদপুরের হাসানআলী জুবিলী স্কুলে সরকারী রিলিফ কেন্দ্রে প্রায় ১২০০ উৎখাত ব্যক্তি আশ্রয়লাভ করিয়াছিল, ইহারা আশ্রয়চ্যুত ও অন্নহীন হইয়াছে, ২০০ লোক বেসরকারী আশ্রয়ে স্থানলাভ করিয়াছে, বাকী সহস্রের পুনরায় নিরুদ্দেশ যাত্রা আরম্ভ হইয়াছে। চাঁদপুরের গণি হাই ইংলিশ স্কুলে সরকারী রিলিফ কেন্দ্রে প্রায় ৬০০/৭০০ উৎখাত আশ্ৰয়লাভ করিয়াছিল, তাহাদের সম্বন্ধেও একই ব্যবস্থা অবলম্বিত হইয়াছে এবং তাহারাও এখন নিরুদ্দেশ। হয় মৃত্যু, নয় ধর্মান্তর—এই যে দুই বিকল্পের সম্মুখীন হইয়া ইহারা ভিটামাটির মায়া কাটাইয়া চলিয়া আসিয়াছিল, আভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রতিকারের দ্বারা সেই বিকল্পসম্ভাবনা দূর করিতে সরকারী কর্মচারীদের যোগ্যতা ও উৎসাহের যথেষ্ট পরিচয় নাই। অথচ এই বিকল্প-সম্ভাবনা বর্তমান থাকিতে ইহাদের পূর্বস্থানে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য করার পরিণাম কি তাহাও দুর্বোধ্য নহে।
বেসরকারী ব্যবস্থার প্রয়োজনঃ
সরকারী ব্যবস্থা যাহাই হউক, বেসরকারী ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখিতেই হইবে। যে সকল স্থানে আশ্রয়প্রার্থী-সমাবেশ হইয়াছে, তথায় আহার্যের সরবরাহ স্থানীয় বন্দোবস্তের দ্বারাই হইবে কিন্তু বাহির হইতে ঔষধপথ্যাদির যথেষ্ট এবং নিয়মিত সরবরাহ প্রয়োজন। ২৩শে নভেম্বর নোয়াখালির কয়েকটি রিলিফ কেন্দ্রের একটা সাধারণ হিসাব লইয়া দেখিয়াছিলাম; তথাকার আংশিক প্রয়োজন মিটাইতেই কমপক্ষে ৪০,০০০ কম্বল দরকার। বয়স্কদের জন্য বস্ত্র এবং শিশু ও বালক বালিকাদের আচ্ছাদনের প্রয়োজনীয়তা তো রহিয়াছেই। মোটকথা, দুইটা জেলার একটা বিধ্বস্ত সমাজকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে এবং তাহাও যথেষ্ট অনুকূল আবেষ্টনের মধ্যে নহে। এই অবস্থার সম্মুখীন হইবার জন্য যা করণীয় তাহার অনেকটাই বেসরকারী প্রয়াসের উপর নির্ভর করিবে। ঘটনার পর দুই মাস হইয়া গেল বটে; কিন্তু কর্তব্য ও দায়িত্ব বহনের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয় নাই। (ক্রমশ)
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।