নোয়াখালি ও ত্রিপুরার অংশবিশেষে উপদ্রবের অব্যবহিত পরে গত ১৯শে অক্টোবর বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির প্রতিনিধিরূপে যখন অবস্থা পরিদর্শনে গিয়াছিলাম, সভ্যতার শ্মশানবহ্নি তখনও সমানভাবে জ্বলিতেছে। একমাস পরে পুনরায় গিয়া দেখিলাম শ্মশানবহ্নি নিভিয়াছে বটে, কিন্তু পরিব্যাপ্ত চিতার অঙ্গারে ও অস্থিতে জনপদের পর জনপদ পরিকীর্ণ হইয়া রহিয়াছে। প্রথমবারের পরিদর্শনের সময় দূর হইতে যাহা দেখিয়াছিলাম, এবারে তাহার পরিণাম নিকট হইতে দেখিলাম, পূৰ্বে যাহা অনুমানে বুঝিয়া লইতে হইয়াছিল, এবারে তাহা প্রত্যক্ষে উপলব্ধি করিলাম। প্রথমবারে দূর হইতে সাধারণভাবে দেখিয়া যে ধারণা মনের মধ্যে উদিত হইয়াছিল, এবারে সম্মুখে ও প্রত্যক্ষ সবিশেষ দেখিয়া সেই ধারণাই বহুগুণ দৃঢ়তারসহিত স্থিরীকৃত হইল,-
“It is a misnomer to characterise these happenings merely as ‘lawlessness’ or ‘communal disturbance’. They are nothing short of a total war upon the minority community waged in the name of a political organisation with the ministry under its control and with the officialdom either in collusion or as a conniving party.”
“It is a misnomer to characterise these happenings merely as ‘lawlessness’ or ‘communal disturbance’. They are nothing short of a total war upon the minority community waged in the name of a political organisation with the ministry under its control and with the officialdom either in collusion or as a conniving party.”
নোয়াখালি জেলার লোকসংখ্যার যাহারা কিঞ্চিদধিক এক-ষষ্ঠাংশ মাত্র, সেই ক্ষীণসংখ্যক হিন্দুসমাজের বিরুদ্ধে ইহা এক সর্বগ্রাসী সংগ্রাম। উপদ্রুত অঞ্চলের হিন্দু সমাজ সৰ্বাংশে ও সর্বপ্রকারে বিধ্বস্ত হইয়াছে— সমাজে, ধৰ্ম্মে, সম্পদে ও প্রতিষ্ঠায়; হিন্দু-অধ্যুষিত সমস্ত গ্রাম এবং অন্যান্য গ্রামের হিন্দু-অধ্যুষিত সমস্ত অংশ উপদ্রুত ও বিধ্বস্ত।
বর্ণনাতীত ধ্বংসকাৰ্যঃ
সাশ্রুনয়নে এই প্রলয়ঙ্কর ধ্বংসের দৃশ্যসমূহ দেখিতে দেখিতে কেবলি ভাবিয়াছি আর আপনাকে আপনি প্রশ্ন করিয়াছি—এই যাহা ঘটিয়াছে, ইহার কতটুকু আমরা বর্ণনা করিতে বা প্রকাশ করিতে পারিলাম? সংবাদপত্রের সীমাবদ্ধ পরিসরে, সংবাদপত্রের সুনির্দিষ্ট প্রকাশরীতিতে ইহার কতটুকু প্রকাশ করা সম্ভব? গ্রামের পর গ্রাম, গৃহের পর গৃহ দগ্ধ, ভগ্ন ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত, অগণিত জনমণ্ডলীর এই অসহনীয় ক্লেশ, ইহাকে ভাষায় রূপ দিতে হইলে যে বাগবিভূতি প্রয়োজন তাহা কোথায়? তাহা কাহারই বা আছে? কেহ যদি সিনেমার বর্ণবহুল ছবি তুলিবার ক্যামেরা লইয়া গিয়া ফটো তুলিয়া আনিত, তাহা হইলে হয়তো কিছু প্রকাশ করা যাইত। মাত্র ভাষায় তাহার শতাংশের একাংশও প্রকাশিত হইবার নহে। ঘটনার প্রথম হইতেই শাসনকর্তৃপক্ষের মুখে শুনিতেছিলাম, সংবাদপত্রসমূহ অতিরঞ্জন করিয়াছে। কিন্তু ঘটনার একমাস পরেও যে ধ্বংসাবশেষ পড়িয়া আছে তাহা দেখিয়া বুঝিলাম অতিরঞ্জন করা দূরে থাকুক, সংবাদপত্রসমূহ ইহার কিছুই বুঝাইয়া উঠিতে পারে নাই। যেটুকু পারিত বাঙলা গবর্ণমেন্টের নিষেধাজ্ঞায় তাহা প্রতিরুদ্ধ হইয়াছে। নন্দনপুরের ধ্বংস, দালালবাজারের ধ্বংস, চণ্ডীপুরের ধ্বংস, হাইমচরের নমঃশূদ্র সমাজের বিরাট ধ্বংস বুঝাইতে হইলে ‘আনন্দ মঠের’ রচয়িতার পুনরাবির্ভাব প্রয়োজন।
এই বিরাট ও ভয়াবহ ধ্বংসকাণ্ডকে লঘু প্রতিপন্ন করিবার জন্য যাহারা চেষ্টা করিয়াছে, তাহাদিগকে সভ্যতা ও মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে অপরাধী বলিয়া বিবেচনা করা উচিত। ঘটনার প্রথম হইতে গবর্ণমেন্টের মুখপাত্রগণ ইহাই করিয়া আসিতেছেন। মন্ত্রী হইতে আরম্ভ করিয়া গবর্ণর পর্যন্ত সকলের এই এক চেষ্টা—উপদ্রবের বাস্তবতাই সকলে অস্বীকার করিতে চাহিয়াছেন। লর্ড ওয়াভেল মুখ খুলিয়া কিছু বলেন নাই। কিন্তু তিনিও যে নোয়াখালির উপদ্রবের ভীষণতা উপলব্ধি করিয়াছেন, তাহার কোন প্রমাণ তাঁহার আচরণ হইতে পাই নাই। এমন কি, গত ১৯শে নভেম্বর তারিখে স্বয়ং নোয়াখালির অধিবাসী বাঙলার মন্ত্রী মৌলবী গফরাণ মহাশয়ের যে বিবৃতি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতেও অস্বীকৃতির এই অপচেষ্টা সমানভাবে পরিস্ফুট।
ধ্বংসকাণ্ডের বিচারঃ
এই ধ্বংসের পরিমাণ ও প্রকৃতি বিচার করিবার সময়ে কয়েকটা কথা বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে হইবে। পূর্বেই বলিয়াছি উপদ্রুত ও বিধ্বস্ত জনসমাজ সমগ্র জেলার জনসংখ্যার কিঞ্চিদধিক এক-ষষ্ঠাংশ মাত্র। নোয়াখালির জনসংখ্যার মধ্যে ১৮ লক্ষ মুসলমান, মাত্র ৪ লক্ষ হিন্দু; জেলার যে অংশ উপদ্রুত সেই চারিটি থানার লোকসংখ্যায় মুসলমান ৭,৮১,১৪৫ এবং হিন্দু ১,৬৮,১১৪, অর্থাৎ হিন্দুরা জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ মাত্র। সুতরাং ধ্বংসের পরিমাণ ও ব্যাপকতা বিচার করিতে গিয়া যাহারা সমগ্র অঞ্চলের দিকে চাহিয়া বিচার করিবেন, তাহাদের বিচারে ভুল হইবে। সহসা দেখিয়া কেহ যদি বলে অধিকাংশ অঞ্চলই অক্ষত আছে, তাহা সত্য; কারণ, লোকসংখ্যায় যাহারা অধিকাংশ তাহারা উপদ্রুত নহে। মাইনরিটি সম্প্রদায় হিসাবে যাহারা উপদ্রুত, কেবল সেই হিন্দুসমাজের অবস্থার দিকে চাহিয়াই বিচার করিতে হইবে এবং তাহাতেই সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি হইবে কি মারাত্মক সংহারের প্রয়াস লইয়া আক্রমণের পরিকল্পনা রচিত হইয়াছিল। দ্বিতীয় স্মরণ রাখিবার বিষয়, বিমান হইতে দেখিয়া অবস্থার যেটুকু উপলব্ধি হয়, প্রকৃত অবস্থার তুলনায় তাহা কিছুই নহে। বিমান হইতে দেখিবার সময় অত্যন্ত উর্বর ভূমিতে ঘনসন্নিবিষ্ট বনরাজীর অবরোধ ধ্বংসস্তুপকে দৃষ্টির অন্তরাল করিয়া রাখে; বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত বলিয়াও সৰ্বস্থলের ধ্বংসের ব্যাপকতা উপলব্ধি হয় না। প্রথম পরিদর্শনের সময়ে বিমান হইতেও যে ধ্বংসক্রিয়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হইয়াছিল, তাহার কারণ তখনও সদ্য-প্রজ্বলিত বহ্নির লেলিহান শিখা চতুষ্পার্শ্বস্থ আবেষ্টন অতিক্রম করিয়া উর্দ্ধে উঠিতেছিল, সদ্য-সমাপ্ত গৃহদাহের ধূমকুণ্ডলী তখনও তরুশীর্ষে পুঞ্জীভূত হইয়া আকাশপথে দেখা যাইতেছিল। ইহা ছাড়া উপদ্রবের আর একটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করিয়াছি। যে প্রধান রাজপথ উপদ্রুত অঞ্চলকে বেষ্টন করিয়া চৌমুহনী হইতে লক্ষ্মীপুরের দিকে গিয়াছে, তাহার উভয় পার্শ্বে ঠিক সংলগ্ন অংশে উপদ্রবের চিহ্ন পরিস্ফুট নহে। প্রশস্ত রাজপথ বহুস্থলে খণ্ডিত, ভগ্ন ও দুর্গম ; রাজপথের উপর উপদ্রবের চিহ্ন ইহাই মাত্র প্রত্যক্ষ ; কিন্তু গৃহদাহাদি লক্ষ্য করিতে হইলে পথের সংলগ্ন অংশ ছাড়িয়া অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ ও লক্ষ্য করিতে হইবে। ইহা পূৰ্ব্ব-পরিকল্পিত ব্যবস্থার ফল কিনা জানি না। তবে ইহা নিশ্চিত যে, এই ব্যবস্থার ফলে প্রথম দিকের পরিদর্শকেরা এবং মিলিটারী পর্যন্ত বিভ্রান্ত হইয়াছে। বাহির হইতে যাহারাই গিয়াছে স্থানীয় শাসনকর্তৃপক্ষ তাহাদিগকে এই পথ দিয়া ঘুরাইয়া অক্লেশেই বুঝাইয়া দিতে পারিয়াছেন যে, কোথাও কিছু হয় নাই, হিন্দু সংবাদপত্রসমূহ অনর্থক অতিরঞ্জিত প্রোপাগাণ্ডা করিতেছে মাত্র। শুনিতে পাই, ব্রিগেডিয়ার থাপারের পর্যন্ত প্রথম দিকে এইরূপ বিভ্রম ঘটিয়াছিল।
অতিরঞ্জন!
কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি সংবাদপত্রসমূহ অতিরঞ্জিত করে নাই। যাহা ঘটিয়াছে সংবাদপত্রসমূহ সে ভীষণতার সামান্যই প্রকাশ করিতে সমর্থ হইয়াছে। প্রথম যাহারা সংবাদ দিয়াছিল তাহাদের অত্যুক্তি ঘটিয়াছিল মাত্র একটা বিষয়ে—মৃত্যুসংখ্যায়। অন্যান্য অপরাধ ও অপরাধের পাশবিকতার সংবাদে তাহাদের বর্ণনা বাস্তবের বহু নিম্নে রহিয়া গিয়াছে। মৃত্যুসংখ্যা নির্ধারণে যে আধিক্য ঘটিয়াছে, তাহাও তাহাদের ইচ্ছাকৃত নহে। তৎকালীন অবস্থাবশতঃ অপরিহার্যভাবেই ইহা ঘটিয়াছে। যে যে অবস্থায় একদিকে অবাধ, অবিচারিত ও নির্মম হত্যার অভিযান চলিয়াছে এবং অপরদিকে ক্রমাগত দুই তিন দিন বা তাহারও অধিককাল ধরিয়া সমগ্র হিন্দুপল্লীর অধিবাসী শৈবালপ্রচ্ছন্ন জলের মধ্যে, নিবিড় ও দীর্ঘ প্রসারিত ধান্যক্ষেত্রের মধ্যে, কণ্টকাকীর্ণ বেতসজঙ্গলের মধ্যে লুকাইয়া আত্মরক্ষা করিয়াছে; লোকবসতি শূন্য হইয়া গিয়াছে; পরিবার বিচ্ছিন্ন ও ছত্রভঙ্গ হইয়া গিয়াছে; সেই অবস্থায় জনশূন্য পল্লীর সকল লোককেই কেহ যদি মৃত অনুমান করিয়া সংবাদ দিয়া থাকে তাহাতে বিস্মিত হইবার কি আছে? বরং সেই অবস্থায় তাহাই স্বাভাবিক বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে। পাকিস্থানী অভিযানে যাহারা সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া বাহির হইয়াছিল, তাহাদের কর্মপদ্ধতির প্রথম করণীয়ই ছিল হত্যা, হত্যার পর যাহারা রহিল তাহাদের ধর্মান্তর, নারীহরণ, লুণ্ঠন ও গৃহদাহ। সুতরাং হত্যার পরিমাণ যে আরও অধিক হয় নাই তাহা কাহারও অনুগ্রহে নহে—নিতান্তই ঘটনাচক্রে। প্রথম সংবাদ দাতাদের সংবাদে যেমন মৃত্যুসংখ্যার অত্যুক্তি ঘটিয়াছিল তেমনি সরকারী সংবাদে উহাকে লঘু করিবার চেষ্টাও অতিমাত্রায় প্রকট যদিও সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। প্রধান মন্ত্রী মিঃ সুরাবর্দী প্রথমে ১০০ পৰ্য্যন্তও উঠিতে সম্মত হন নাই—রামগঞ্জে তাহার সর্বশেষ বক্তৃতায় ২০০ পর্যন্ত উঠিয়াছেন; কাউন্সিল অব ষ্টেটের বিবৃতিতে ভারত গবর্ণমেন্টের শাসন পরিষদের অন্যতম লীগসদস্য সর্দার আবদুর রব নিস্তার উঠিয়াছেন ৩০০ পর্যন্ত। দেখা যাইতেছে, মৃত্যুসংখ্যা সম্বন্ধে গবর্ণমেন্টও নিশ্চিত নহেন। করপাড়ার রায় সাহেব রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর গৃহের ও অন্যান্য মৃত্যুসংখ্যা প্রথমে শোনা গিয়াছিল ২১, তাহার পরে হইল ২৬, আমরা যখন গিয়াছিলাম তখন পর্যন্ত মৃত্যুসংখ্যা দাঁড়াইয়াছে ৩৪। যাহা শুনিয়াছি তাহাতে মনে হয় এই একটি স্থানের মৃত্যুসংখ্যাই আরও অধিক বলিয়া প্রমাণিত হইবে। যাহারা উৎখাত হইয়া দূরে গিয়া অভাবে ও ব্যাধিতে মরিয়াছে তাহাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। যাহারা স্বস্থানে থাকিয়া বা উহার বাহিরে নীত হইয়া নিহত হইয়াছে তাহাদের কথাই ভাবিতেছি। তাহাদের সঠিক সংখ্যা কেহ নির্ধারণ করিতে পারিবে কি? কখনও নির্ধারণ সম্ভব হইবে কি?
[বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির তৎকালীন সভাপতি শ্রীসুরেন্দ্রমোহন ঘোষের যে বিবৃতি ১৮ই অক্টোবর প্রকাশিত হয়, তাহাতে তিনি বলিয়াছিলেন নিহতের সংখ্যা ৫ হাজার। এখানে অত্যুক্তি ঘটিয়াছে সত্য। কিন্তু নিহতের সংখ্যা এইরূপ অতিপ্রভূত না হইলেও উহা যে প্রভূত তাহাতে সন্দেহ নাই। কিরূপ পাইকারী হারে হত্যা করা হইয়াছিল তাহা লক্ষ্য করিলেই অবস্থা উপলব্ধি হইবে। করপাড়ায় নিহতগণের মধ্যে একমাত্র রায় চৌধুরীদিগের গৃহে যাঁহারা নিহত বা নিখোঁজ হইয়াছিলেন তাহাদের সংখ্যাই ২৭। গোপাইরবাগ গ্রামের দাস পরিবারের ২২জন পুরুষের মধ্যে ৯ জন নিহত হয় ; ৩ জন কোনক্রমে পলায়ন করিতে সমর্থ হয়। তৎকালীন পাবনার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের ভাগিনেয় আবুল কাসেম নামে এক ব্যক্তি এই হত্যাকাৰ্য্য করে। গোবিন্দপুরে (বড় গোবিন্দপুর) রায় ও ভৌমিক পরিবারের হত্যাকাণ্ডও এই প্রকার। এই হত্যাকাণ্ডে মোট ২৭ জন নিহত হয়। গোমাতলী গ্রাম হইতে পুলিশ প্রহরাধীন দত্তপাড়ার আশ্রয়কেন্দ্রে আসিবার পথে প্রায় শতাধিক আশ্রয়প্রার্থী নরনারী আক্রান্ত হয়। অন্ততঃ ১৯ জন সদ্য সদ্য নিহত হয়। যাহারা আহত হইয়া প্রাণে বাঁচিয়া থাকে তাহাদের মধ্যেও কয়েকজন তৎকালে মুমূর্ষু হইয়াছিল।
এইরূপ পাইকারী হত্যা ছাড়া আরও হত্যা হইয়াছে বহু। অনেকগুলির বিবরণও আছে, সব দিবার স্থান নাই। তাহা ছাড়া, পলায়নের পথে নৌকায় যাহারা নিহত ও জলে নিক্ষিপ্ত হয় এবং যাহাদের মৃতদেহ হত্যাকারিগণ কত্তৃক অপসারিত হওয়ার ফলে বিবরণ পাওয়া যায় নাই এরূপ ঘটনাও অনেক। পরিবারের পুরুষদিগকে হত্যা এবং নারীদিগকে হরণ,- ইহাই আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল। পরিবারের বাস ও গ্রাম বিধ্বস্ত, বহু পরিবার লুপ্ত এবং বহু পরিবার উৎসন্ন হওয়ার ফলে সঠিক বিবরণ পাইবার সম্ভাবনা নষ্ট হইয়াছে। পুলিশ অফিসারেরাও অপরাধের হিসাব রাখিবার কোন আগ্রহ দেখান নাই। সদ্য সদ্য যে যাহা সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিল তাহাই মাত্র রহিয়া গিয়াছে। সমস্ত বিবেচনা করিয়া মনে হয় বাঙলার গভর্ণর স্যার ফ্রেডারিক বারোজের রিপোর্টের প্রতিবাদে শরৎচন্দ্র স্বীয় বিবৃতিতে যাহা বলিয়াছিলেন সংখ্যা সেইরূপই হইবে; অর্থাৎ ৫ সহস্র না হউক, উহা যে সহস্রের কোঠায় থাকিবে, তাহা নিঃসন্দেহ। হত্যার কাৰ্য্যে যে সকল বীভৎসতা অবলম্বন করা হইয়াছিল তাহা উল্লেখ করিলাম না।]
ঐতিহাসিক ঘটনাঃ
নোয়াখালি-প্রসঙ্গের একদিকে কলিকাতা ও অপরদিকে বিহার ধ্বংসের ব্যাপকতায় নোয়াখালির ঘটনা কলিকাতাকে বহুদূর অতিক্রম করে। বস্তুতঃ নোয়াখালি-ত্রিপুরায় যাহা ঘটিয়াছে তাহা আকস্মিক উপদ্ৰবমাত্র নহে, তাহা ঐতিহাসিক ঘটনার পর্যায়ভুক্ত। এই বর্বর ভীষণতার স্মৃতিচিহ্ন অপসারিত হইতে ৫০ বৎসর যাইবে এবং স্মৃতি অবলুপ্ত হইতে লাগিবে অনূন্য এক শতাব্দী। মুর্শিদ কুলি খাঁ বা কালাপাহাড়কে ইতিহাস এখনও বিস্মৃত হইতে পারে নাই। নোয়াখালির উপদ্রবও তেমনিভাবে ইতিহাসে স্থানলাভ করিবে। রাষ্ট্রশাসন এক অধিকার হইতে অন্য অধিকারে যাইবার সময় অরাজকতা দেখা দিলে যাহা ঘটে—শ্রেণী বা সমাজকে যেভাবে উপদ্রুত ও বিধ্বস্ত হইতে হয়-ভারতের ইতিহাসে একাধিকবার রাষ্ট্রবিপর্যয়ের সময়ে যাহা ঘটিয়াছে, নোয়াখালির ঘটনা সেই ঐতিহাসিক পর্যায়ে স্থান পাইবে—ইতিহাসের সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ইহার বিচার করিতে হইবে। নোয়াখালির ঘটনার এই ঐতিহাসিকতার সহিত তুলনায় বিহারের ঘটনা প্রতিক্রিয়াসঞ্জাত আকস্মিক ব্যাপার মাত্র।
নোয়াখালির ধ্বংসস্তুপ হইতে বাহিরে আসিয়া মনে হইতেছে এক দারুণ দুঃস্বপ্নের আবেষ্টন হইতে মুক্তি পাইয়াছি—একটা প্রচণ্ড বিভীষিকা যেন চতুষ্পার্শ্ব হইতে সরিয়া গিয়াছে। ভীষণতার ও নির্মমতার সেই নিদর্শনসমূহ দূর হইতে এখন যেন কল্পনার বস্তু বলিয়া বোধ হইতেছে। যে উপদ্রুত সমাজকে নিত্য ও সর্বক্ষণ ইহা প্রত্যক্ষ করিতে হইতেছে ও ইহারই মধ্যে যাহাদের বাস করিতে হইতেছে, আপনার মনের দিকে চাহিয়াই তাহাদের মনের অবস্থা বুঝিতে পারিতেছি। পরিদর্শনকালে আমাদের সাথী আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানীগণকে বারবার বলিতে শুনিয়াছি—যুদ্ধের মারণাস্ত্রসমূহও এইরূপ ভয়াবহ ধ্বংস ঘটাইতে পারে না। যুদ্ধের ধ্বংস দেখি নাই। কিন্তু নোয়াখালিতে ও ত্রিপুরাতে যাহা দেখিয়াছি, তাহা ভুলিবার নহে-ভুলিবার নহে—ভুলিবার নহে!
(১১.১২.৪৬) (ক্রমশঃ)
(১১.১২.৪৬) (ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।