তাঁহার এই উক্তি শুনিয়া তখনই সকলে বুঝিতে পারিয়াছিল যে, তিনি প্রকৃত অবস্থা কিছুই প্রত্যক্ষ করেন নাই, স্থানীয় শাসনকর্ম্মচারীরা যাহা সাজাইয়া গুছাইয়া বুঝাইয়া দিয়াছে, তিনি তদনুযায়ী কথা কহিতেছেন। জেনারেল বুসারের এই উক্তির তিনসপ্তাহাধিককাল পরে পুনরায় দেখিতে গিয়া জেলার বিধ্বস্ত ও জনশূন্য অঞ্চলসমূহের মধ্য দিয়া নিঃশব্দে পরিভ্রমণ করিতে করিতে জেনারেল বুসারের এই কথা সৰ্ব্বক্ষণ স্মরণ হইত এবং বিস্মিত হইয়া ভাবিতাম—এত বড় দায়িত্বপূর্ণ সরকারী পদে অধিষ্ঠিত কৰ্ম্মচারী এত বড় অবিশ্বাস্য কথা কহিলেন কেমন করিয়া? যে সকল স্থানীয় কর্মচারী তাহাকে এই অভিমত গঠনের তথ্য যোগাইয়াছে তাহারাই বা কিরূপে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত কাজ করিল?
(১) উপদ্রুত অঞ্চলে সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সম্প্রদায়ের সাধারণ অভ্যুত্থান ঘটে নাই।
(২) উপদ্রব করিয়াছে বহিরাগত গুণ্ডারাই—স্থানীয় লোক কিছু কিছু তাহাদের সঙ্গে যোগ দিয়াছিল।
(৩) উপদ্রবের চূড়ান্ত বিবরণে প্রমাণিত হইবে যে, উহার প্রাথমিক সংবাদে অত্যন্ত অত্যুক্তি করা হইয়াছিল (grossly exaggerated )।
ইহার পর আলোচনাপ্রসঙ্গে প্রশ্নোত্তরে জেনারেল বুসার তাঁহার এই সকল সিদ্ধান্তের হেতু কিছু কিছু প্রকাশ করেন। সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সম্প্রদায়ের ব্যাপক সাধারণ অভ্যুত্থান ঘটে নাই এই সিদ্ধান্তের হেতুস্বরূপে তিনি বলিলেন তাহা হইলে সহরগুলি রক্ষা পাইত না; কিন্তু বস্তুতঃ সহরগুলি আক্রান্ত হয় নাই। এই সিদ্ধান্ত একবার মানিয়া লইলে পরবর্তী সিদ্ধান্তটিও সঙ্গে সঙ্গেই আসিয়া পড়ে যে, উপদ্রব সংঘটিত হইয়াছে প্রধানতঃ বহিরাগত ও কিছু কিছু স্থানীয় গুণ্ডাদের দ্বারাই। যে বিস্তৃত এলাকা জুড়িয়া দিনের পর দিন ব্যাপক উপদ্রব চলিয়াছে তাহা স্মরণ করাইয়া দিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম— ‘মাত্র গুণ্ডার দ্বারা ইহা সম্ভব কিনা’। উত্তরে তিনি বলিয়াছিলেন “কেন হইবে না? হাজারখানেক গুণ্ডার দ্বারা ইহা বেশ ঘটিতে পারে, প্রতি ২০ বর্গ মাইলের জন্য ৫ জন গুণ্ডাই যথেষ্ট।” ১০ হাজার, ১৫ হাজার লোক মিলিয়া এক একটি অঞ্চল আক্রমণ করিয়াছে এ কথাটাকে তিনি একেবারে উড়াইয়াই দিলেন, বলিলেন—“১৫ হাজার লোকের দাঁড়াইতে কত জায়গা লাগে, একবার হিসাব করিয়া দেখিয়াছেন কি—৫ মাইলের কম নহে।” এইরূপ যাহার ধারণা তিনি যে বলিবেন প্রাথমিক রিপোর্টে অত্যন্ত অত্যুক্তি করা হইয়াছে এবং চূড়ান্ত রিপোর্টে তাহাই প্রমাণিত হইবে—ইহা কিছুমাত্র বিচিত্র নহে।
(১) প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক
(২) স্থানীয় হাইস্কুলের ও কলেজের ছাত্র
(৩) জেলায় প্রত্যাগত কলেজের ছাত্র
(৪) বেকারগণ। এই চতুর্থ শ্রেণীর মধ্যে পূর্বতন মিলিটারীদের ধরা যাইতে পারে। একটি সুবিদিত কিশোরীহরণের [করপাড়ায় নিহত রায় সাহেব রাজেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর গৃহ হইতে অপহৃত নমিতা রায় চৌধুরী।] ব্যাপারে অগ্রবর্তী বলিয়া যিনি অভিযুক্ত তিনি স্থানীয় এক হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। একাধিক পাশব ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের নায়ক [পূর্ব অধ্যায়ে উল্লিখিত গোপাইরবাগ গ্রামের দাস পরিবারের হত্যাকাণ্ডের নায়ক, আবুল কাসেম। এই ব্যক্তি তৎকালীন পাবনার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের ভাগিনেয়।] কোনো ম্যাজিষ্ট্রেটের ভাগিনেয়। দ্বিতীয়টিকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয় নাই। কিন্তু ইহা হইতেই সুস্পষ্ট হয় আক্রমণ কোন শ্রেণীর লোকের দ্বারা হইয়াছে এবং কিভাবে হইয়াছে। বাটাদল ও ডানলপদলের [বাটা কোম্পানী ও ডানলপ কোম্পানীর পূর্ববঙ্গবাসী এক শ্রেণীর মুসলমান কর্মচারী। কলিকাতায় ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্টের হাঙ্গামার পর ইহারা ছুটী লইয়া দল বাঁধিয়া পূর্ব্ববঙ্গে বিশেষতঃ নোয়াখালি ত্রিপুরা অঞ্চলে গিয়াছিল।] নাম ইতিপূর্বে প্রকাশিত হইয়াছিল। এই প্রসঙ্গে তাহারও পুনরুল্লেখ করা যাইতে পারে। মোটের উপর সম্প্রদায়বিশেষের আবালবৃদ্ধবনিতার অধিকাংশকে বা একটা বৃহৎ অংশকে যদি “গুণ্ডা” আখ্যা দেওয়া যায়, তাহা হইলেই নোয়াখালি-ত্রিপুরার আক্রমণকে গুণ্ডার আক্রমণ বলা যাইতে পারে, নতুবা নহে।

(২৭.১২.৪৬) (ক্রমশ)
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।