বাঙলায় ও বিহারেঃ
বাঙলার দাবদাহ লাগিয়া বিহার প্রদেশে যে অশান্তির বহ্নি প্রধূমিত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা জ্বলিয়া উঠিতে না উঠিতেই নিৰ্বাপিত হইয়া আসিয়াছে। গান্ধীজীর আত্মাহুতির সঙ্কল্পে, বড়লাট এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিমণ্ডলের কংগ্রেস ও লীগ মন্ত্রীদের দ্রুত হস্তক্ষেপে তথা প্রাদেশিক গবর্ণমেন্টের ক্ষিপ্ৰকারিতায় ইহা সম্ভব হইয়াছে। সপ্তাহকালের মধ্যে বড়লাট দুইবার পাটনায় ছুটিয়াছেন—একবার স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে এবং আর একবার। অন্যতম লীগ মন্ত্রী সর্দার নিস্তারের সহিত; কেন্দ্রীয় গবর্ণমেন্টের প্রধান মন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল উপদ্রুত অঞ্চলের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করিয়া জনতার সম্মুখীন হইয়াছেন, তাহাদিগকে তিরস্কার করিয়াছেন এবং বিমান হইতে বোমাবর্ষণের দ্বারা উপদ্ৰবকারীদিগকে নির্মল করা হইবে বলিয়া সতর্ক করিয়াছেন; একবার সর্দার নিস্তারের সহিত এবং পুনরায় জেনারেল বুসারের সহিত বিমান হইতে তিনি উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করিয়াছেন, ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং আচার্য্য কৃপালনী বিহারে উপস্থিত হইয়া উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করিতেছেন, সেনাবাহিনী গ্রামাঞ্চলের অভ্যন্তরভাগে প্রেরিত হইয়াছে এবং তাহারা যতদূর সম্ভব কঠোরভাবে উত্তেজনা দমন করিতেছে—একটি গ্রামেই একশতজন তাহাদের গুলিতে নিহত হইয়াছে এবং ইহারই অনুপাতে আহত হইয়াছে।
উপদ্রবের তুলনাঃ
এইভাবে অষ্টবজ্রসম্মেলন করিয়া কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনের কর্ণধারগণ বাঙলা হইতে বিহারে প্রসারিত অশান্তির অগ্নিশিখাকে যে সদ্য সদ্য নিরুদ্ধ ও নিৰ্বাপিত করিয়াছেন তজ্জন্ত তাঁহারা সমগ্র ভারতবর্ষের ধন্যবাদভাজন। বাঙলাদেশে আমরা—যাহারা গত ১৬ই আগষ্ট হইতে অরাজকতা ও শান্তির সমবেত দাবদাহে অহর্নিশ দগ্ধ হইতেছি—নেতৃবৃন্দের এই চেষ্টার গুরুত্ব ও সাফল্য বিশেষভাবেই উপলব্ধি করি। তবু বিহারের উপদ্ৰবকারীরা লোকের ধৰ্মনাশ করে নাই— নারীর সতীত্বনাশ করে নাই—স্ত্রীর চক্ষের উপর স্বামীকে হত্যা করিয়া স্বামিহন্তার সহিত তাহার বিবাহের অভিনয় করিয়া পৈশাচিক প্রবৃত্তির পরিচয় দেয় নাই। বিহারে যাহা ঘটিয়াছে—তাহা হত্যা, লুণ্ঠন ও গৃহদাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাঙলা দেশে আমরা মাত্র এই দণ্ড দিয়াই যদি অব্যাহতি পাইতাম তাহা হইলেও আজ অদৃষ্টকে ধন্যবাদ দিতাম। কিন্তু আমাদিগকে যে নিগ্রহ ভোগ করিতে হইয়াছে রাষ্ট্রপতি কৃপালনীর ভাষায় তাহা হত্যা অপেক্ষাও ভয়াবহ। বিহারে যারা উৎপীড়িত ও উপদ্রুত তাহাদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপনের সঙ্গে এই সান্ত্বনা অনুভব করিতেছি যে তাহাদিগকে অসহায়ভাবে জননী, ভগিনী ও কন্যার চরম লাঞ্ছনা চক্ষের উপর দেখিতে হয় নাই—বলপূর্বক ধর্মান্তরিত হওয়ার যে গ্লানি মনুষ্যত্বের সেই চরম গ্লানি তাহাদিগকে ভোগ করিতে হয় নাই।
বিহারের উপদ্রুত অঞ্চল দেখিয়া পণ্ডিত জওহরলাল বলিতেছেন— “ইহা ভয়াবহ।” পণ্ডিতজীর কথা অস্বীকার করিব না, শুধু এইটুকু নিবেদন করিয়া রাখিব—১৬ই আগষ্ট হইতে তিন দিন ধরিয়া কলিকাতার গৃহে ও রাজপথে যে ভয়াবহতা দেখা দিয়াছিল তাহা তিনি দেখেন নাই, ১০ই অক্টোবর হইতে নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলায় যে ভয়াবহতার অবাধ প্রাদুর্ভাব ঘটিয়াছিল তাহা তিনি দেখেন নাই। কলিকাতায় “প্রত্যক্ষ সংগ্রামের বিভীষিকাময়ী সেই তিন রাত্রির ভয়াবহতা আমরা দেখিয়াছি—দেখিয়াছি কৃষ্ণা রজনীর নিবিড় অন্ধকারের পটভূমিকায় রাজধানীর বুকের উপর প্রজ্বলিত শ্মশানবহ্নি দিঙ্মমণ্ডল রাঙ্গাইয়া তুলিতেছে,—দেখিয়াছি প্রচণ্ড আক্রমণ-ধ্বনির আতঙ্কে নিশীথশয্যায় নিদ্রিত শিশুর দল বারবার শিহরিয়া কঁদিয়া উঠিতেছে; কলিকাতার সেই শ্মশানবহ্নির শিখা আজ বিহারকে স্পর্শ করিয়াছে—বাঙলার পূর্বপ্রান্তে নোয়াখালিতে সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধৰ্ম্ম ও মনুষ্যত্বের যে বিশাল চিতা রচনা করা হইয়াছিল সেই প্রজ্বলিত চিতাবহ্নির প্রতিচ্ছায়া, পশ্চিম দিগন্তকে রক্তিম করিয়া তুলিয়াছে—পণ্ডিতজী ভয়াবহতার প্রতিরূপ দেখিয়াছেন, উহার স্বরূপ দেখিবার দুর্ভাগ্য ঘটিয়াছে আমাদেরই।
শাসনের পার্থক্যঃ
কলিকাতায় “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম” উপলক্ষ্য করিয়া যখন বিভীষিকার অকস্মাৎ প্রাদুর্ভাব, তৎকালে প্রাদেশিক শাসনের চরম ব্যর্থতা প্রকট। শাসন কর্তৃপক্ষ হয় নিষ্ক্রিয়—নয় উদাসীন—নয় অক্ষম। যে কারণেই হউক, তাহারা গুণ্ডাশাহীর নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছেন আর তাহারই সুযোগে রাজধানীর বুকের উপর লুণ্ঠন, হত্যা ও নারীহরণের অবাধ তাণ্ডব চলিয়াছে! তিন দিনের শোণিতোৎসবে অন্যূন পাঁচ সহস্র লোক সদ্য প্রাণ দিয়াছে এবং আরও অন্যূন পঞ্চদশ সহস্র আহত হইয়াছে ; স্মরণীয় কালের মধ্যে রাজশাসনের এত বড় ব্যর্থতা দেখা যায় নাই। তথাপি এই বিভীষিকা প্রকাশ্যে ঘটা সত্ত্বেও এবং প্রধান মন্ত্রী সুরাবর্দী মহাশয়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অভিযোগ শুনিয়াও কোথা হইতে কেহ মন্ত্রিমণ্ডলের কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে অগ্রসর হয় নাই। তৎকালে কংগ্রেস কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদে প্রবেশ করেন নাই [কংগ্রেস নেতৃগণ কেন্দ্রীয় শাসনপরিষদের কার্যভার গ্রহণ করেন ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬। মুসলীম লীগ তখনও যোগ দিতে অসম্মত। লীগের সহিত লর্ড ওয়াভেলের ও কংগ্রেসপক্ষের মীমাংসার পর শাসনপরিষদের লীগসদস্যগণের নাম বিজ্ঞাপিত হয় ১৫ই অক্টোবর এবং ইহার পর সপ্তাহকালের মধ্যে তাহারা কাৰ্যভার গ্রহণ করেন।] —বড়লাট লর্ড ওয়াভেল একাই সৰ্বময় প্রভু। মুসলিম লীগের “প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অনুষ্ঠিত কলিকাতার সেই নাদিরশাহী লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চক্ষের উপর দেখিয়া তাহার অব্যবহিত পরেই ২৫শে আগষ্ট তিনি কেন্দ্রীয় শাসনপরিষদে যোগ দানের জন্য লীগকে আহ্বান করিলেন এবং বাঙলার মন্ত্রিমণ্ডল অপসারণের সকল অনুরোধ অগ্রাহ করিয়া লীগকে আশ্বাস দিয়া বলিলেন : “My new Government will not have any power or indeed any desire to trespass on the field of provincial administration” অর্থাৎ— “আমি যে নূতন গবর্ণমেন্ট গঠন করিব, প্রাদেশিক শাসনে হস্তক্ষেপ করিবার কোন ক্ষমতা বা অভিপ্রায় তাহার থাকিবে না।”
কলিকাতায় অনুষ্ঠিত কাণ্ডের দ্বারা লীগদল এই পুরস্কার ও প্রশংসাপত্র পাইবার পর নোয়াখালি। বীভৎস অত্যাচারে ও বিভীষিকা সঞ্চারে তাহা কলিকাতার মহা-হত্যাকাণ্ডকেও হার মানাইয়া দিল। তখন কংগ্রেস শাসনপরিষদে যোগ দিয়াছেন কিন্তু লীগ দেন নাই; লীগের শুভাগমনের জন্য ক্ষেত্ররচনায় লর্ড ওয়াভেল অতিমাত্রায় ব্যস্ত। নোয়াখালির উৎপীড়িত মানবতার আর্তনাদ দিল্লীর প্রাসাদদ্বারে আছাড় খাইয়া পড়িল, কিন্তু সে পাষাণপুরীতে কোনো স্পন্দন দেখা দিল না। বড়লাট লর্ড ওয়াভেল দ্রুত নোয়াখালি অভিমুখে ছুটিলেন না, বা তাঁহার মন্ত্রীদেরও যাইবার জন্য উৎসাহিত করিলেন না, বিজ্ঞের পরামর্শ দিয়া বলিলেন—“জিন্নার সহিত মিটাইয়া লও।”
কংগ্রেস পরিচালনায় যাহার নিঃশব্দ কঠোর শাসন বারবার প্রত্যক্ষ করিয়াছি, সেই সর্দার বল্লভভাই পৰ্য্যন্ত নোয়াখালির সমস্ত ঘটনা শুনিয়া ১৩ই অক্টোবর দিল্লীতে নিখিল ভারতীয় সংবাদপত্র-সম্পাদক-সম্মেলনের সভায় বলিলেন— “The Centre had no desire to interfere with the Provinces and they all wanted the Provinces to have the widest possible discretion in all matters.”
“প্রদেশের কাৰ্যে হস্তক্ষেপ করিবার কোন ইচ্ছা কেন্দ্রীয় গবর্ণমেন্টের নাই। তাহারা সকলেই চাহেন প্রদেশসমূহের সকল বিষয়ে যতদূর সম্ভব স্বেচ্ছানুযায়ী চলিবার ক্ষমতা থাকিবে।”
“প্রদেশের কাৰ্যে হস্তক্ষেপ করিবার কোন ইচ্ছা কেন্দ্রীয় গবর্ণমেন্টের নাই। তাহারা সকলেই চাহেন প্রদেশসমূহের সকল বিষয়ে যতদূর সম্ভব স্বেচ্ছানুযায়ী চলিবার ক্ষমতা থাকিবে।”
বিহারে অশান্তি ঘটিবার পূর্ব পর্যন্ত ইহাই দেখিয়াছি। কলিকাতার ঘটনার পর এবং পুনরায় নোয়াখালির ঘটনার পর বাঙলার শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের জন্য পুনঃ পুনঃ অনুরুদ্ধ হইয়াও বড়লাট ও তাহার মন্ত্রিমণ্ডল নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রিয় থাকার নীতিই অনুসরণ করিয়াছেন। কিন্তু বিহারের ঘটনায় তাহাদের নীতি অকস্মাৎ আমূল পরিবর্তিত হইয়াছে—অকস্মাৎ বড়লাট ও তাহার মন্ত্রিপরিষং সমানভাবে সচল ও সক্রিয় হইয়া উঠিয়াছেন। প্রদেশের শাসনে হস্তক্ষেপ না করিবার অভিপ্রায় প্রদেশের সকল বিষয়ে যতদূর সম্ভব স্বেচ্ছানুযায়ী চলিবার অধিকার সমস্ত পরিবর্তিত হইয়াছে। কেন্দ্রীয় গবর্ণমেন্টের প্রধান মন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল বিহারে পদার্পণ করিয়া একেবারে সরাসরি বিমান হইতে বোমাবর্ষণের ভীতি প্রদর্শন করিয়াছেন। ১৯৪২ সালের আগষ্ট আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন ভারত গভর্ণমেন্ট যে চরম দণ্ডের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন আজ বিহারের সাম্প্রদায়িক অশান্তি দমনের জন্য বর্তমান ভারত গবর্ণমেন্টের প্রধানমন্ত্রী পুনঃ পুনঃ সেই দণ্ডই উদ্যত করিতেছেন—বড়লাট বারবার ছুটিয়া আসিতেছেন।
বাঙলার প্রশ্নঃ
প্রদেশের অশান্তি নিবারণের জন্য মন্ত্রিমণ্ডল সহ বড়লাটের এই শক্তি প্রয়োগ দেখিয়া সমগ্র বাঙলা দেশের মর্মস্থল মথিত করিয়া এক প্রশ্ন উঠিতেছে—প্রাদেশিক অশান্তি দমনে বড়লাট ও তাহার মন্ত্রীদের যখন এত ক্ষমতা ও এমন অধিকার রহিয়াছে তখন বাঙলা দেশে তাহা প্রয়োগ করা হইল না কেন? কলিকাতায় “প্রত্যক্ষ সংগ্রামের” তাণ্ডবের সময় এবং নোয়াখালির পৈশাচিক অত্যাচারের সময় কেন বড়লাট ও তাহার মন্ত্রীরা সদ্য সদ্য ছুটিয়া আসিলেন না? কেন বিমান হইতে বোমাবর্ষণের ভীতি প্রদর্শনের দ্বারা দুর্বৃত্তগণকে নিবৃত্ত করিলেন না? গ্রামবিশেষেই একশত লোককে নিহত ও বহুলোককে আহত করিয়া তাহার বিহারকে যেভাবে সায়েস্তা করিতেছেন, বাঙলায় প্রথম দিকে উদ্যোগী হইলে এতটা করিবারও হয়তো প্রয়োজন হইত না—উদ্যত ও দৃঢ় হস্তে দণ্ড প্রয়োগের সঙ্কল্প ঘোষণা করিলেই চলিত—বহু নারীর চরম লাঞ্ছনা নিবারিত হইত, বহু লোক ধৰ্মনাশের চিরন্তন গ্লানি হইতে রক্ষা পাইত। বাঙলায় মুসলিম লীগের “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম” হইতে উদ্ভূত বহ্নিদাহকে উপযুক্ত বিধিব্যবস্থা প্রয়োগে সময় থাকিতে নিবারণ করিলে বিহারে এ অগ্নিকাণ্ড ঘটিত না—বিহার লইয়া তাহাদিগকে বিব্রত হইতে হইত না—পণ্ডিত জওহরলালকে বিমান হইতে বোমাবর্ষণের ভীতি প্রদর্শন করিতে হইত না—মহাত্মাজীকে প্রায়োপবেশনের সঙ্কল্প গ্রহণ করিতে হইত না।
বিহারের অশান্তি থামিয়াছে—বাঙলার গৃহদাহও একদিন থামিবে। কিন্তু বাঙলার বুক হইতে এই যে প্রশ্ন গুমরিয়া উঠিতেছে, এই প্রশ্ন থাকিয়া যাইবে এবং একদিন না একদিন বর্তমান কেন্দ্রীয় গবর্ণমেন্টকে ইহার সম্মুখীন হইতে হইবে। বড়লাট লর্ড ওয়াভেল কি জবাব দিবেন জানি না; কিন্তু কংগ্রেস ও লীগের সমবেত মন্ত্রিমণ্ডলকে বাঙলার নিকট এই প্রশ্নের জবাবদিহি করিতেই হইবে—এই সঙ্কটের সময়ে তাঁহারা কেন এমন নীতি অবলম্বন করিলেন, যাহা প্রদেশে প্রদেশে এবং সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে পৃথক রূপ পরিগ্রহণ করে?
(৯/১১/৪৬) (ক্রমশঃ)
(৯/১১/৪৬) (ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।