বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে ঘোষণা পাওয়া শহীদ জগৎজ্যোতি দাস। মুক্তিযুদ্ধে ভাটি বাংলার এ বীর যোদ্ধাকে বীরত্বের খেতাব হিসেবে বীরশ্রেষ্ঠ পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিল অস্থায়ী সরকার। কিন্তু পরে তা আর দেয়া হয়নি, কারণটাও জানা যায়নি।তবে অনেকে মনে করেন হিন্দু হওয়ার কারণে তার বীরশ্রেষ্ঠ পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েও তা কেড়ে নেয়া হয়। বাংলাদেশেকে ইসলামীকরণের প্রথম বীজ এখানেই বপন করা হয় বলেও অনেকে মনে করেন। হিন্দু হওয়ার কারণে শহীদ জগৎজ্যোতি দাসের বীরশ্রেষ্ঠ পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েও তা কেড়ে নিয়ে দেশে বিদেশে সমালোচিত হয় মুজিব সরকার।
বাংলার এই বীর সন্তানের জন্ম ১৯৪৯ সালে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলায়। আজমিরীগঞ্জেই শৈশব কৈশোর কাটে তার। এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়াও সেখানেই করেছিলেন, এরপর যান ভারতের আসামে। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে চাকরিতে যোগ দেয়ার কথা ছিল। সেই সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন, তার আগে জন্মস্থানে আসেন সবার সাথে দেখা করার জন্য। তবে, দেশে এসে আর চাকরিতে যোগ দিতে ভারত যান নি জগৎজ্যোতি। ৭৫ টাকা বেতনে নিজ গ্রাম জলসুখার কৃষ্ণগোবিন্দ পাবলিক হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর আবার এই চাকরি ছেড়ে স্নাতকে ভর্তি হন সুনামগঞ্জ কলেজে।
বাংলার এই বীর সন্তানের জন্ম ১৯৪৯ সালে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলায়। আজমিরীগঞ্জেই শৈশব কৈশোর কাটে তার। এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়াও সেখানেই করেছিলেন, এরপর যান ভারতের আসামে। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে চাকরিতে যোগ দেয়ার কথা ছিল। সেই সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন, তার আগে জন্মস্থানে আসেন সবার সাথে দেখা করার জন্য। তবে, দেশে এসে আর চাকরিতে যোগ দিতে ভারত যান নি জগৎজ্যোতি। ৭৫ টাকা বেতনে নিজ গ্রাম জলসুখার কৃষ্ণগোবিন্দ পাবলিক হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর আবার এই চাকরি ছেড়ে স্নাতকে ভর্তি হন সুনামগঞ্জ কলেজে।
১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ে জগৎজ্যোতি ছিলেন সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র এবং কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। এসময় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারতের শিলংয়ে প্রশিক্ষণ নিতে যান তিনি। যোগ দেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পে। বাংলার ভাটি অঞ্চলের সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা এবং হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৫ নং সেক্টর। এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়্ত্বি পান তৎকালীন মেজর শওকত আলী। ৫ নং সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের দায়িত্ব প্রাপ্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অধীনে প্রথমত জগৎজ্যোতি বিভিন্ন আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা দল, যার নাম দেওয়া হয় ফায়ারিং স্কোয়াড ‘দাস পার্টি’। জগৎজ্যোতির শেষ যুদ্ধের অন্যতম সঙ্গী আবদুল কাইয়ুমের বয়ানে জানা যায়, দাস পার্টি নামটি জনগনের দেওয়া নাম নয়, দাস পার্টির অফিসিয়াল দলিল ছিল এবং পার্টি কমান্ডার হিসেবে জগৎজ্যোতি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তার সাহস ও দক্ষতার জন্য তাকে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা দলের নেতৃত্ব দিয়ে পাঠানো হয় ভাটি অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়ে। তার নেতৃত্বের গেরিলা দলটিই পরিচিতি পায় দাস পার্টি নামে। মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের কাছে দাস পার্টি ছিল এক আতংকের নাম। একের পর এক যুদ্ধে তারা পাকসেনাদের হারিয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে থাকে। নেত্রকোনার ভেড়ামোহনা, কালনী, কুশিয়ারা, সুরমা, দিরাই, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জের নৌপথ দখল মুক্ত করতে লড়াই করে এই দাস পার্টি। তাদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানি সেনারা।
অনেকগুলো সফল অপারেশন সম্পন্ন করে দাসপার্টি। তার মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তানীদের কার্গো বিধ্বস্ত করা, বার্জ নিমজ্জিত করা, পাহাড়পুর অপারেশন, বদলপুর অপারেশন। দাস পার্টিকে মোকাবেলা করতে পাকিস্তানি সেনারা শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। বদলপুর অপারেশনের সময় হেলিকপ্টারও ব্যবহার করে পাকসেনারা।
যেভাবে শহীদ হনহবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত বদলপুর। থানা সদর থেকে উত্তর-পূর্বে এর অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এলাকা ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত ছিল। কিন্তু এই এলাকার বেশ কিছু যুদ্ধ ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাব সেক্টর থেকে পরিচালিত হয়েছে। ১৫ নভেম্বর জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ নিয়ে টেকেরঘাট থেকে সন্ধ্যার পর বানিয়াচংয়ের উদ্দেশে রওনা দেন। টেকেরঘাট সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানার অন্তর্গত। তাঁরা নৌকাযোগে আসছিলেন। ১৬ নভেম্বর সকালে তাঁরা বদলপুরে পৌঁছেন। সেখানে এসে জগৎজ্যোতি জানতে পারেন একদল রাজাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে বসে চাঁদা আদায় করছে। এ কথা শুনে তিনি তাদের আক্রমণ করেন। তাঁদের আক্রমণে দুজন রাজাকার নিহত হয় এবং দুজন আত্মসমর্পণ করে। বাকিরা পালিয়ে যায়। এমন সময় পাশের জলসুখা গ্রাম থেকে গুলি হতে থাকে। এ গ্রামেই জগৎজ্যোতির বাড়ি। তিনি কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সেদিকে রওনা হন। বাকিদের দুই ভাগে ভাগ করে একদলকে পাঠান পিটুয়াকান্দি। অপর দলকে আজমিরীগঞ্জের দিকে। এর মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটি দল শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জ থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। অবস্থা প্রতিকূল দেখে জগৎজ্যোতি জলসুখা না গিয়ে পিটুয়াকান্দিতে চলে আসেন। সেখানে কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছে হটতে থাকে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ধাওয়া করে। ধাওয়ার একপর্যায়ে জগৎজ্যোতি মাত্র তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে অনেক দূর চলে যান। মূল দল বেশ পেছনে থাকে এবং তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এমন সময় পশ্চাদপসরণরত পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের আকস্মিক আক্রমণ করে। জগৎজ্যোতি তিন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেও ব্যর্থ হন। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁর সহযোদ্ধা আবু লাল, গোপেন্দ্র ও উপেন্দ্র শহীদ হন। তাঁর বাম পাঁজরে গুলি লাগে। আহত জগৎজ্যোতিকে জীবিত ধরার জন্য পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে আসছিল। কারণ, তিনি তাদের কাছে টেরর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অনেক অপারেশন করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আহত জগৎজ্যোতি পাকিস্তানি সেনাদের কাছে ধরা পড়ার চেয়ে আত্মাহুতি দেওয়া শ্রেয় মনে করেন। নিজের গুলিতে নিজেই শহীদ হন তিনি। ১৬ নভেম্বরে শহীদ হন বাংলা মায়ের এই বীর সন্তান। পরে জ্যোতির লাশ নিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা। জ্যোতির মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় আজমিরীগঞ্জ বাজারে। তাঁর দেহ আজমিরীগঞ্জের গরুর হাটে একটি খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়া হয়।
বাজারের মানুষের সামনে পেরেক মারা হয় তার সারা দেহে। এরপর জ্যোতির নিথর দেহটি ঝুলিয়ে রাখা হয় সেখানে। পরে এই বীরের দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় কুশিয়ারা নদীতে।
জ্যোতির শহীদ হওয়ার সংবাদ প্রচার করা হয় রেডিও ও পত্রিকায়। তার বীরত্বকে সম্মান দেখাতে অস্থায়ী সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধের মরণোত্তর সর্ব্বোচ্চ খেতাব দেয়ার ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণা প্রচার করা হয়েছিলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। কিন্তু এই বীর যোদ্ধাকে বীরত্বের খেতাব হিসেবে বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয়নি। পরে ১৯৭২ সালে শহীদ জগৎজ্যোতি দাসকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করা হয়।
জ্যোতির শহীদ হওয়ার সংবাদ প্রচার করা হয় রেডিও ও পত্রিকায়। তার বীরত্বকে সম্মান দেখাতে অস্থায়ী সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধের মরণোত্তর সর্ব্বোচ্চ খেতাব দেয়ার ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণা প্রচার করা হয়েছিলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। কিন্তু এই বীর যোদ্ধাকে বীরত্বের খেতাব হিসেবে বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয়নি। পরে ১৯৭২ সালে শহীদ জগৎজ্যোতি দাসকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করা হয়।
দাস পার্টি গেরিলা দলের দুর্ধর্ষ নেতা জগৎজ্যোতি দাসের নামে বর্তমানে সুনামগঞ্জ শহরে একটি পাঠাগার রয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য পাঠকের সমাগম ঘটে এই পাঠাগারে।
তোর রক্তের দাগ যদি পুষে রাখে রাগ, তবে রাগটাকে পুষে রাখবি
ছোটো ছোটো কুঁড়িদের ফোটাবি বলে তুই আবার ফিরে আসবি।
তথ্যসূত্র:
- দৈনিক প্রথম আলো, "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না" | তারিখ: ০8-১২-২০১১
- হাসান মোরশেদ (২০১৬, আগস্ট)। দাস পার্টির খোঁজে। ঢাকা: মেরিট ফেয়ার প্রকাশন। পৃষ্ঠা ১২৮, ১৩৮। আইএসবিএন 984-70131-0429-3
|
- sylhettoday.com
দাসপার্টির খোঁজে:খসড়া পর্ব-১,
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।