রোজা ও অটোফেজির মধ্যে পার্থক্য !
চারিদিকে রোজার উপকারিতা নিয়ে মহা ধুমধামে প্রচারণা চলছে। মূলত ফাস্টিং বা মেডিকেল ফাস্টিং এর উপকারিতা গুলো গুগল করে সেগুলোকে রমজানের ফাস্টিং বা রোজার উপকারিতা বলে চালানো হচ্ছে। রোজার তথা একটানা বারো-পনেরো ঘন্টা পানি না খেয়ে থাকার শারীরিক ক্ষতি বা মানসিক ক্ষতি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে এই লেখা নয়। এখানে কেবল রোজার সাথে মেডিকেল ফাস্টিং এবং অটোফ্যাজির পার্থক্য তুলে ধরা হল। আমাকে আরো অবাক করেছে প্রথম আলোতে একজন কার্ডিলজিস্ট (ডাক্তার) ডাঃ রেয়ান আনিস যিনি বলছেন রোজা থাকলে ব্লাড প্রেসার কমে, রক্তে সুগার কমে, হার্টের ডিজিস কমে!তার কাছে আমার প্রশ্ন বাংলাদেশে প্রচুর ব্লাড প্রেসার এবং হার্টের রোগী আছে।@ Prothom Alo |
রোজা ও অটোফেজির মূল পার্থক্য হলো রোজার সময় কিছুই খাওয়া যায় না। অন্যদিকে অটোফেজির সময় অল্প কিছু খাবার এবং জল বা জুস খাওয়া বাধ্যতামূলক। নিচেই দুটি জিনিস বিশ্লেষণ করা হলো। কারো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে করুন।
রোজা:
১। আল্লাহর নামে শুরু ও শেষ হয়। এখানে মেডিকেল কোন ভালো দিক চিন্তা করে করা হয় না।
২। একমাত্র আল্লাহকে কত ভালবাসে তা প্রমাণ করার জন্য করতে হয়।
৩। কোন খাবারই গ্রহণ করা যায়না।
৪। স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে হয়।
৫। রোজা সূর্য ওঠার আগ সূর্য অস্ত পর্যন্ত। কোথাও ৬ ঘন্টা কোথাও ২৩-২৪ ঘন্টা! অবস্থান হিসেবে আলাদা, ব্যক্তি বিশেষে নয়।
৬। সারাদিন না খেয়ে সারা রাত যত খুশি যত খুশি খাওয়া যায়।
৭। টানা এক মাস করতে হয়।
৮। আল্লাহর নামে চলিলাম, মরি বাঁচি! নানা ধরণের মানসিক ও শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কিন্তু সেগুলো সহ্য করাই আসলে পরীক্ষা!
৯। অতি প্রাচীন কাল থেকেই নানা ধর্মে বা অঞ্চলে নানাভাবে প্রচলিত এবং কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
মেডিকেল ফাস্টিং (অটোফেজি):
১। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে শুরু ও শেষ হয়।
২। প্রধানত নানা রকম টেস্ট করতে, ওজন কমাতে, চিকিৎসার প্রয়োজনে করতে হয়। সুস্থ থাকতেও করা যেতে পারে। সাধারণত সপ্তাহে এক দিন যা সারা বছর করা যেতে পারে।
৩। পানি, নানা তরল খাবার বা ওষুধ এমনকি সামান্য খাবার গ্রহণ করা যায়।
৪। নির্দিষ্ট ব্যায়াম/কাজকর্ম করতে হয় বা এড়িয়ে চলতে হয়।
৫। ব্যাক্তি ও চাহিদা অনুযায়ী সময় নির্ধারিত হয়। ৪ ঘন্টা থেকে ১৬ ঘন্টা হতে পারে।
৬। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট খাবার খেতে হয়।
৭। নির্ধারিত সময়ে করতে হয়।
৮। কোন সমস্যা দেখামাত্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।
৯।এটা বিজ্ঞানসম্মত ।
এটা একেবারেই আলাদা বিষয়, এটা আসলে রোজার সাথে এক করা যায়না। এটা হয় কারণ এটা শারীরিক স্ট্রেসের একটা রেসপন্স। এর শাব্দিক অর্থ হল নিজেকে খাওয়া। খাবার না পেয়ে কোষগুলো নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলে, বিশেষত বর্জ্য গুলো, এবং সেখান থেকেই পুষ্টি উপাদান আলাদা করে নেয়। অনেক প্রাণীতে এটা হয় এমনকি উদ্ভিদেও। জাপানী নোবেল প্রাপ্ত বিজ্ঞানী এটা আবিস্কারও করেননি, তিনি আবিস্কার করেছেন ইস্টের একটি জিনকে যেটা তাতে অটোফ্যাজি ট্রিগার করে। আর তিনি বলেনও নি যে উপবাস থাকতে হবে কিনা বা কতক্ষণ করতে হবে। আদৌ কীভাবে কতদিন উপবাস করতে হবে এবং সেটা উল্টো ক্ষতিকর হবে কিনা সেসব নিয়েও তিনি গবেষণা করেন নি। অথচ পানি বা ফলমূল খেলেও অটোফ্যাজি ট্রিগার হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের একদম প্রাথমিক কথা এটা যে একটানা দীর্ঘক্ষণ পানি না খেয়ে থাকা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কেবল নির্দিষ্ট মেডিকেল টেস্টের বা নির্দিষ্ট চিকিৎসা গ্রহণের পূর্বে সেটা বলে দেয়া হয়।
এটার সাথে রোজাকে এক করে দেখা আর দশটা ধর্মীয় অপপ্রচারের মত একটি ছাড়া কিছুই নয়।
অটোফেজি কি? কিভাবে কাজ করে আমাদের শরীরে?
আমাদের দেহের কোষগুলি নিয়মিত ভাঙ্গে এবং তারপরে তাদের নিজস্ব অংশগুলিকে ক্রমাগত পুনঃচক্র (recycle) করে। ২০১৬ সালে, জাপানের ড: ইয়োশিনোরি ওহসুমি (Dr. Yoshinori Ohsumi), এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত মেকানিজম (যা অটোফেজি (autophagy) নামে পরিচিত) আবিষ্কারের জন্য ফিজিওলজি বা মেডিসিনের উপর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আমাদের দেহের অধিকাংশ টিস্যু নিয়মিতভাবে তাদের কোষগুলিকে নতুন করে প্রতিস্থাপন করে। প্রতিটি অঙ্গ সম্পূর্ণরূপে নিজেকে নবায়ন করার জন্য নিজের মত সময় নেয়। তবে, অন্যান্য টিস্যু তাদের কোষ প্রতিস্থাপন না।জাপানের কোষ জীববিজ্ঞানী ড: ওহসুমি কয়েক বছর ধরে অধ্যয়ন করেন মানব কোষ তাদের কিভাবে বজ্রকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে তার উপর।এই প্রক্রিয়া বৈজ্ঞানিকভাবে অটোফেজি (autophagy) নামে পরিচিত । এটি গ্রিক শব্দদিয়ে গঠিত। "অটো" যার অর্থ "স্ব" এবং "ফেজিন" যার অর্থ "খাওয়া" হিসাবে অনুবাদ করা যেতে পারে। এটি একটু বিরক্তিকর শোনাচ্ছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি আপনাকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে।লাইসোসোমের (lysosome) সাহায্যে (অন্ত্রবৃত্তান্ত্রিক উপাদান হ্রাসের জন্য দায়ী যে গুলি), আপনার শরীর বিভিন্ন প্রোটিন কাঠামো ভাঙ্গতে পারে এবং তাদেরকে অ্যামিনো অ্যাসিড রূপান্তর করতে পারে। পরে, এটি আরও কোষ (cell) তৈরি করতে পারে ।আমাদের শরীরে ক্ষতিগ্রস্ত কোষ এবং ব্যাকটেরিয়া আকারে সংরক্ষিত থাকা প্রোটিন থেকে নিজস্ব প্রোটিন ব্যবহার করতে পারে। এক ব্যক্তি গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০ গ্রাম প্রোটিন খায় যা নতুন কোষ তৈরি করতে যথেষ্ট নয়। "প্রোটিন বর্জ্য" ব্যবহার করে আমাদের শরীর প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্ট লাভ করে। যখন প্রাকৃতিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রক্রিয়া কাজ করে না তখন ক্ষতিগ্রস্ত কোষ এবং তাদের উপাদান শরীরের মধ্যে জমা হতে শুরু করে। সুতরাং, ক্যান্সার কোষ এবং বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস সংক্রামিত কোষগুলি নিরপেক্ষ করা সম্ভব নয়। এই জন্য আমাদের শরীরে অনেক গুরুতর রোগের আক্রমণ হতে পারে ।তার সমস্ত গবেষণায়, ডাঃ ওহসুমী বিষাক্ত কোষ ভেঙে ফেলার জন্য এবং সমস্ত বর্জ্য পরিত্রাণ পেতে, শরীরকে উত্তেজিত করার জন্য উপবাস করেছিলেন। আপনি যখন উপবাস করেন আপনার কোষ আরও দীর্ঘজীবী হয় এবং আরো শক্তি উত্পাদন করে । আপনার শরীরের কম প্রদাহ (inflammation) হয়। উপরন্তু যদি আপনি শরীরে ক্যালোরি কমাতে চান তবে আপনার শরীরের নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে - এটি একটি অণু (molecule) যা শরীর হতে টক্সিক উপাদান রিমুভ করতে এবং দেহকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করে। বিরতি নিয়ে উপবাস (Intermittent fasting), যা বলতে বুঝায় উপবাসের মধ্যে অল্প করে খাওয়া যা শরীরকে পরিষ্কার (রাসায়নিক বা জৈবিক বজ্র) করতে সাহায্য করে । উপরন্তু, এটি ওজন কমাতে এবং বিপাক (metabolism) ক্রিয়া বা তাড়াতাড়ি হজম করতে সাহায্য করে। এভাবে উপবাস করার সুবিধা অনেক। এর ফলে হার্ট জনিত রোগ, নিউরোলজিকাল সমস্যা এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি, এবং প্রদাহ, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং রক্তচাপ কমায় । আপনি যদি এই পদ্ধতিটি গ্রহণ করেন তবে আপনি সাধারণত একদিনে যেমন খান তেমনি খাবেন এবং পরবর্তী দিনে উপবাস করবেন। এর অর্থ এই নয় যে উপবাসের সময় আপনি মোটেও খাবেন না । যদি আপনি নিয়মিত দিনে 2,000 ক্যালোরি খান তবে আপনার উপবাসের দিনে 500 ক্যালোরি খাবেন ( তার মানে অল্প খাবেন )।আপনি যদি জীবনে এই প্রথম উপবাস শুরু করেন একবারের জন্য খাবার বাদ দেয়া আপনার কাছে একটু ভীতিজনক মনে হতে পারে। সাধারণত, প্রতিদিন এক বার খাবার এড়াতে (না খেলে) পারলে আপনার বিপাককে বাড়িয়ে দেয় এবং আপনার শরীরের পরিষ্কারকরণ প্রক্রিয়াগুলি সক্রিয় হয় । মনে রাখবেন যে যদি আপনি কোন একবার খাবার ছাড়েন ( না খান ) তবে আপনাকে পরবর্তীতে অতিরিক্ত খেতে হবে না।সীমিতউপবাস হলো ব্রেক (intermittent) দিয়ে উপবাস । এটি অনুসরণ করার জন্য, প্রতিদিন দিনে ৮ ঘন্টা অন্তর খেতে হবে। এই পদ্ধতিটির আরেকটি নাম "উপবাস ১৬/৮" কারণ আপনি বাকী 16 ঘন্টার মধ্যে খেতে পারবেন না। আপনি যদি এই পদ্ধতিতে নতুন হন তবে কম কঠোর পরিকল্পনার চেষ্টা করুন। আপনি সকাল ৮ টায় সকালের নাস্তা করতে পারেন এবং সন্ধ্যা ৬ টায় ডিনার করতে পারেন। সুতরাং, আপনি শুধু ১0 ঘন্টা না খেয়ে থাকবেন । যখন আপনি এর সাথে অভ্যস্ত হবেন তখন উপবাসের টাইম বাড়াতে হবে (মনে আছে আমাদের টার্গেট এখানে ১৬ ঘন্টা )।
আপনি যদি এই কৌশল অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেন, তবে সপ্তাহের একদিন নির্বাচন করুন!
মনে রাখবেন উপবাসের মধ্যে ফ্রেশ জল এবং চিনি ছাড়া জুস অবশ্যই পান করতে হবে । এই জন্য বসন্ত সেরা সময় কিন্তু আপনি সারা বছর ধরে এই খাদ্য অনুসরণ করতে পারেন।
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।