হিন্দু নারীরা জীবন বাঁচাতে যেভাবে সতীদাহ ও জাওহার বেছে নিতেন - UHC বাংলা

UHC বাংলা

...মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী একটি গ্লোবাল বাংলা প্লাটফর্ম!

ব্রেকিং নিউজ

Home Top Ad

Friday, February 15, 2019

হিন্দু নারীরা জীবন বাঁচাতে যেভাবে সতীদাহ ও জাওহার বেছে নিতেন


মুসলিম শাসকদের হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষার জন্য ভারতের অনেক প্রদেশে নারীরা একসাথে আগুনের কুণ্ডলীতে ঝাঁপ দিতো যা জাওহার নামে পরিচিত।
সতীদাহ বাঙালি হিন্দু সমাজে অতিপরিচিত একটি বিষয় হলেও জাওহার (Jauhar) শব্দটির সাথে আমরা তেমন পরিচিত নই। তবে পদ্মাবতীর কল্যানে জাওহার শব্দটি আমাদের সামনে এসেছে। তবু অনেকে সতীদাহ ও জাওহার বিষয়টি একদৃষ্টিতে দেখছেন। আসলে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেকে আবার বিষয় দুটি একেবারে গুলিয়ে ফেলছেন। সেদিন বিবিসি বাংলার একটি রিপোর্ট দেখলাম পদ্মাবতী সিনেমা নিয়ে। সেখানেও তারা বিষয় দুটি এক করে ফেলেছেন যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তাই আমি বিষয়টি  ইতিহাস ঘেটে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। 
সতীদাহ প্রথা হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে বা আত্মহুতি দেবার ঐতিহাসিক প্রথা, যা
রাজা রামমোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই প্রথা বন্ধ হয়।গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খৃষ্টাব্দ ৪০০) পূর্ব হতেই এ প্রথার প্রচলন সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়।
গ্রিক দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের সাথে ভারতে এসেছিলেন ক্যাসান্ড্রিয়ার ঐতিহাসিক এরিস্টোবুলুস। তিনি টাক্সিলা (তক্ষশীলা) শহরে সতীদাহ প্রথার ঘটনা তার লেখনিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। গ্রিক জেনারেল ইউমেনেস এর এক ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে তার দুই স্ত্রীই স্বত:প্রণোদিত হয়ে সহমরণে যায়; এ ঘটনা ঘটে খৃষ্ট পূর্বাব্দ ৩১৬ সালে।
আরো দেখুন : বেদের কোথাও উল্লেখ্য না থাকা সত্ত্বেও হিন্দু সমাজে কিভাবে সতীদাহ এলো ? 

পৌরানিক ও মধ্যযুগীয় আদর্শ:
মূলতঃ স্বত:প্রণোদিত হয়েই পতির মৃত্যুতে স্ত্রী অগ্নিতে আত্মাহুতি দিত। পৌরাণিক কাহিনীতে এ আত্মাহুতি অতিমাত্রায় শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা হত। মহাভারত অনুসারে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে যান কারণ মাদ্রী মনে করেছিলেন পান্ডুর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী যেহূতু পান্ডুকে যৌনসহবাসে মৃত্যুদন্ডের অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল। রাজপুতানায় "জহর ব্রত" প্রচলিত যাতে কোন শহর দখল হবার পূর্বেই পুরনারীরা আত্মসম্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ (বা জহর বা বিষ) দিয়ে স্বেছায় মৃত্যুবরণ করতেন, যা সতীদাহের অনুরূপ। কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে হিন্দু স্ত্রীকে সহমরণএ বাধ্য করা হত। বিশেষ করে কোন ধনী লোকের মৃত্যুর সম্পত্তি অধিকার করার লোভে তার আত্মীয়রা তার সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে, ঢাক-ঢোলের শব্দ দ্বারা তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার স্বামীর সাথে চিতায় শুইয়ে পুড়িয়ে মারতো।
"এক হিন্দু সতী"
সতীদাহ প্রথা রদ :
১৮২৯ সালের ডিসেম্বর ৪-এ বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতিদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এসময় বেঙ্গলের গভর্ণর ছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক। অবশ্য এ আইনী কার্যক্রম গৃহীত হয় মূলতঃ রাজা রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই। এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করা হয় ।
প্রিভি কাউন্সিল ১৮৩২ সালে বেঙ্গলের গভর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের ১৮২৯ এর আদেশ বহাল রাখেন। খুব অল্পসময়ের মধ্যে ভারতের অন্যান্য কোম্পানী অঞ্চলেও সতীদাহ প্রথাকে বাতিল ঘোষণা করা হয়।
এখনো আমরা অধিকাংশ বাঙালি জাওহার শব্দটির সাথে পরিচিত নয়। সেদিন দেখলাম বিবিসি বাংলায় পদ্মাবতী নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে সতীদাহ ও জাওহার বিষয় দুইটি গুলিয়ে ফেলেছে। এই দুইটি বিষয় কখন এক নয়। আমি আগেই বলেছি সতীদাহ প্রথা হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে বা আত্মহুতি দেবার ঐতিহাসিক প্রথা যেখানে স্ত্রী মৃত স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিতো।

সতীদাহ প্রথা হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে বা আত্মহুতি দেবার ঐতিহাসিক প্রথা যেখানে স্ত্রী মৃত স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিতো।
 পক্ষান্তরে, জাওহার (Jauhar) হচ্ছে মুসলিম শাসকরা যখন কোন নতুন হিন্দু রাজ্য দখল করতো তখন যুদ্ধে হিন্দু সৈন্য, রাজা বা অন্যান্যদের মৃত্যুর পর (অথবা আগে) তাদের স্ত্রীদের জোরপূর্বক ধর্ষণ বা বিয়ে করতো। তাই হিন্দু নারীরা নিজ স্বামীর করুন মৃত্যুর পর অথবা আগে নিজের সম্ভ্রম মুসলিম শাসকদের হাতে তুলে দেবার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করতো। তাই হিন্দু নারীরা মুসলিম শাসকদের হাত থেকে রক্ষার জন্য আগুনে ঝাঁপ দিয়ে বা বিষ পানে আত্মহত্যা করতো। এই প্রথা রাজস্থানে ও মধ্যপ্রদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।এই প্রথা জাওহার নামে পরিচিত।
ইতিহাসে জাওহার : ৭১২ সালে মুহাম্মদ বিন কাসেম যখন সিন্ধু আক্রমণ করেন তখন এখানকার হিন্দু রাজা ছিলেন দাহির(Dahir)।মুহাম্মদ বিন কাসেম ও তার সৈন্য বাহিনী রাজা দাহিরকে হত্যা করে রাজধানী দখল করে নেয়। তখনো ভিতরের সৈন্যদের দ্বারা রাজমহল সুরক্ষা করে রেখেছিলেন কয়েক মাস ধরে।মুহাম্মদ বিন কাসেম ও তার সৈন্য বাহিনী যখন রাজমহল দখল করে সকল পুরুষ সৈন্যকে হত্যা করে তখন রানী ও ভিতরে থাকা অন্যান্য নারীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
১২৩২ সালে যখন সামসুদ্দিন (দিল্লির সুলতান)  গোয়ালিওর (Gwalior)কেল্লা  আক্রমণ করেন তখন কেল্লায় থাকা সকল নারীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন যারা সবাই ছিলেন রাজপুত। 
১৩০১ সালে যখন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি  (Ranthambhor)রানথামবোর কেল্লা  আক্রমণ করেন তখন কেল্লায় থাকা সকল নারীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এর পর ১৩০৩ সালে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি যখন চিতোরের রানী পদ্মাবতীর সৌন্দর্য্যের কথা জানতে পারেন তিনি কৌশলে রাজার মাধ্যমে রানীকে দেখতে চান। রাজা রানীর সাথে দেখা করতে অস্বীকৃত জানানোর পর আলাউদ্দিন খিলজি সৈন্য সামন্ত নিয়ে চিতোর কেল্লা  আক্রমণ করেন। তখন রানী পদ্মাবতীসহ সকল নারী শয়তান আলাউদ্দিন খিলজি কাছে সম্ভ্রম না হারিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
১৩২৭ সালে মোহাম্মদ বিন তুগলাখ কর্ণাটকের কম্পিলি(Kampili) রাজ্য আক্রমণ করেন তখন সেখানকার নারীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জাওহার সম্পন্ন করেন।
 ১৫২৮ সালে মুঘল সম্রাট বাবর যখন মধ্য প্রদেশের চান্দেরি দুৰ্গ (Chanderi fort) আক্রমণ করেন তখন সেখানকার নারীরা শিশু সন্তানসহ আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জাওহার সম্পন্ন করেন।
এর পর মুসলিম সম্রাট বাহাদুর শাহ ১৫৩৫ সালে আবার চিতোর আক্রমণ করেন। যুদ্ধে চিতোরের রাজা মারা যান। তখন রানী দিল্লির সম্রাট হুমায়ূনকে ভাই হিসেবে রাখী উপহার পাঠান এবং সাহায্য কামনা করেন।কিন্তু হুমায়ূনের সৈন্য বাহিনী পৌঁছানোর আগে দুর্গে ঢুকে যান। তখন রানীসহ ১৩,০০০ হিন্দু নারী বিষ পানে (gunpowder) আত্মহত্যা করেন।এটি চিতোরের দ্বিতীয় জাওহার নামে পরিচিত।
চিতোরের তৃতীয় জাওহার : ১৫৬৭ সালে সম্রাট আকবর রাজস্থানের চিতোর কেল্লা আক্রমণ করেন। আকবরের সৈন্যরা ১৫৬৮ সালের সম্পূর্ণ ভাবে চিতোর দখল করে নেয়। আকবর সেখাকার হিন্দুদের দুইটি চয়েস দিয়ে ছিলেন। হয় ইসলাম গ্রহণ কর নয়তো মৃত্যুকে বেছে নাও। কেউ কেউ জীবন ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু হাজার হাজার হিন্দু পুরুষ মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন। যারা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন আকবরের সৈন্যরা তাদেরকে হত্যা করে রক্তের নদী সৃষ্টি করেছিলেন। আর নারীরা বিষপানে ও আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয়। ইটা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জাওহার।
মধ্যপ্রদেশের রাইসেনে(Raisen) তিনটি জাওহার হয় ১৫২৮, ১৫৩২ ও ১৫৪৩ সালে যখন হুমায়ুন রাইসেন আক্রমণ করেন। এই জাওহারে শতশত মহিলা মারা যান।
১৬৩২ সালে আওরঙ্গজেব মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলা (Bundela) আক্রমণ করেন। আক্রমণের খবর শুনে অধিকাংশ নারীরা জাওহারের মাধ্যমে মৃত্যুকে বেছে নেন। যারা বেঁচে ছিলেন তাদের জেনানা'র মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। পুরুষদের ইসলাম গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। যারা গ্রহণ করেনি তাদের হত্যা করা হয়।
এইসব রাজপূত ও মধ্যপ্রদেশের হিন্দুরা নারীরা যে সবক্ষেত্রে স্বামীর মৃত্যুর পর জাওহারের মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করেছেন তা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা সন্তান সহ আগে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে ( মুসলিম শাসকদের হাত থেকে রক্ষার জন্য )।স্বামীরা পরের দিন শাখা ব্রত পালনের মাধ্যমে যুদ্ধ করতে করতে মারা গেছেন। একটি কথা জেনে রাখা ভালো রাজপূত নারী-পুরুষরা মুসলিম শাসকদের কাছে জীবন্ত গৃহবন্ধী হওয়ার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করতো। 
Video Courtesy: Mufassil Islam


আসুন জানা যাক শাঁখা  ব্রত কি ?
স্ত্রী সন্তানরা জাওহারের মাধ্যমে মৃত্যুর পর দিন সকালে স্বামী স্নান করে গেরুয়া বসন পরতো। এরপর মহাসমাধী থেকে স্ত্রী সন্তানদের চিতা ভস্ম কপালে লাগাতো। মুখে একটি পবিত্র তুলসী পাতা নিতো। এরপর দুর্গের গেট খুলতো। তখন মুসলিম শত্রু বাহিনীর সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হতো। এভাবে মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করাকে শাখা ব্রত বলা হয়।
বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ উইকিপিডিয়া
বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ History Blog: India
 

No comments:

Post a Comment

পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।

অন্যান্য

Post Bottom Ad

আকর্ষণীয় পোস্ট

code-box