বেদের পরিচয়
বেদ কি ?
“বেদ” শব্দে “জানা” অর্থ সংসূচিত হয় । যদ্বারা “জানা” যায় তাহাই বেদ । বেদ সত্য-মিথ্যার স্বরুপ-তত্ত্ব জানাইয়া দেয়; বেদ ধর্ম জানায়; বেদ অধর্ম জানায় । ফলতঃ যাঁহার দ্বারা ধর্মাধর্মের সত্যাসত্যের জ্ঞান লাভ হয়, অর্থাৎ যাঁহার দ্বারা স্বরুপ জানিতে পারা যায়, এক কথায় যাঁহার দ্বারা ঐহিক ও পারত্রিক সর্ব্বসিদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়, তাহাই বেদ । সেই সর্ব্ববিধ জ্ঞানেরই নামান্তর- সত্য -বিষয়ক জ্ঞান, পরমেশ্বর-বিষয়ক জ্ঞান । অতএব, যদ্বারা সত্য-তত্ত্ব অধিগত হয়, পরমেশ্বর-সম্বন্ধে স্বরুপ জ্ঞান জন্মে, পরব্রক্ষ্মকে জানিতে পারা যায় এবং তাঁহাকে সন্মিলিত হইবার আকাঙ্ক্ষা আসে ও তদ্ববিষয়ক উপায়-পরস্পরা অবগত হওয়া যায়, তাহাই বেদ । বেদই আত্মায় আত্মসন্মিলনের একমাত্র উপায় ।
কিবা সামগানে, কিবা মন্ত্রউচ্চারণে, কিবা অন্য কোনরূপ স্তোত্রে, যেখানে যে নামে যে ভাবে ভগবানের অর্চ্চনা করা হউক না কেন, সে সকল অর্চনাই সর্ব্ব-স্বরুপ সেই একেরই উদ্দেশ্য বিহিত হয় । বুঝা উচিত -সকল পুজাই তাঁহার পুজা ।
হে মিত্রদেব ! হে বরুণদেব! হে অদিতি! হে সিন্ধুদেব ! হে পৃথিবীদেব! হে দ্যুদেব অতপরঃ আপনারা আমাদিগকে রক্ষা করুন । তাঁহারা কোথায় অবস্থান করেন, কোথায় থেকে আসিয়া আমাদের রক্ষা করিবেন, কে তাঁহারা ? এই নিয়েই “দেবতাদের স্বরুপ তত্ত্ব” আলোচনায় আনিতে চাহি যদি আজ্ঞা দান করেন ।
বেদ মানব
সভ্যতার সর্বোচ্চ গ্রন্থ। মনুষ্য জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপের সঠিক দিক
নির্দেশনা সম্বলিত এক পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান। অহিংসা,সত্য, উদার এবং মহত্বে
অধিষ্ঠিত হওয়ার উপদেশ বেদ আমাদের দিয়েছে। কিন্তু একটি নিরীহ নির্দোষ প্রাণী
হত্যার দ্বারা কি কখনো মহত্বে অধিষ্ঠিত হওয়া যেতে পারে? বেদ কি আদৌ আমাদের
নির্দোষ প্রাণীদের হত্যা করার শিক্ষা দেয়?
কখনোই না। কারন বেদেই স্পষ্ট আছে – [“অনাগো হত্যা বৈ ভীমা কৃত্যে”(অথর্ববেদ
১০।১।২৯) অর্থাৎ হে হিংসক্রিয়ে, নিরপরাধ এর হত্যা নিশ্চিতভাবে ভয়ংকরপ্রদ]
অতএব নিরাপরাধ পশুদের নিরন্তর রক্ষা করো।
যজুর্বেদ ১৩ অধ্যায়ের ৪৭ – ৫০ নং মন্ত্রগুলোতে ইহা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে-
.
=>>যজুর্বেদ ১৩।৪৭
হে হাজারো প্রকার দৃষ্টিযুক্ত রাজন! তুমি সুখ প্রাপ্ত করার জন্য নিরন্তন
বৃদ্ধি হয়ে এই দ্বিপদী মনুষ্য এবং চতুষ্পদী পশুকে মেরো না। হে জ্ঞানবান!
তুমি পবিত্র অন্ন উৎপন্ন কারী বন্য পশুকে প্রেম করো, তাদের বৃদ্ধি
প্রার্থনা করো। এবং তাদের বৃদ্ধি দ্বারা নিজ সম্পদ বৃদ্ধি হয়ে নিজ শরীর
মধ্যে হৃষ্ট পুষ্ট হয়ে স্থির হও। তোমার সন্তাপকারী ক্রোধ বা তোমার পীড়া,
হিংসক বন্য পশুর প্রাপ্ত হোক। এবং যাদের আমরা প্রীতি করি না, তাদের তোমার
সন্তাপকারী ক্রোধ বা পীড়া প্রাপ্ত হোক।
(অনুবাদঃ জয়দেব শর্মা)
=>> যজুর্বেদ ১৩।৪৮
হে পুরুষ! এই হর্ষ ধ্বনি কারী , যা সব প্রকার কষ্ট সহনের সামর্থ্য এক
ক্ষুরযুক্ত বেগবান,যা সংগ্রামপযোগী পশুদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক বেগবান অশ্ব,
গাধা,খচ্চর আদি পশুকে মেরো না। জঙ্গলে গৌর নামক পশু কে লক্ষ্য করে তোমাকে
আমি এই উপদেশ করছি যে, তাদের বৃদ্ধিতে তুমি নিজেকেও বৃদ্ধি করে নিজ শরীর কে
রক্ষা করো। তোমার শোক, সন্তাপ বা ক্রোধ সেই গৌর নামক ক্ষেতের হানিকারক
মৃগের প্রাপ্ত হোক।যাদের প্রতি আমাদের প্রীতি নেই, তোমার শোক সন্তাপ বা
ক্রোধ তাদের প্রাপ্ত হোক।
(অনুবাদঃ জয়দেব শর্মা)
=>>যজুর্বেদ ১৩।৪৯
আকাশ অন্তরীক্ষের মধ্যে বিবিধ প্রকারে বিস্তার কারী শত ধারা বর্ষনকারী
আশ্রয়, সোমরূপ মেঘের সমান লোক মধ্যে বিদ্যমান শতজনের ধারক পোষক এবং হাজারো
সুখপ্রদ পদার্থের উৎপাদক এই বৃষ কে এবং মনুষ্যের হিতের জন্য ঘী, দুগ্ধ,
অন্ন আদি পুষ্টিকারক পদার্থ প্রদানকারী অহিংসনীয়, পৃথিবী সমান গাভী কে, হে
রাজন! আপন সর্বোৎকৃষ্ট স্থান মধ্যে বা আপন রক্ষন কার্যের মধ্যে তৎপর হয়ে
মেরো না। তোমাকে আমি বন্য পশু গবয় এর উপদেশ করি। উহা দ্বারা নিজ ঐশ্বর্য কে
বৃদ্ধি করে নিজ শরীরকে স্থির করো। তোমার শোক সন্তাপ বা ক্রোধ “গবয়” নামক
পশুর প্রাপ্ত হোক। এবং যেই শত্রুকে আমরা দ্বেষ করি, তোমার সন্তাপ এবং
পীড়াদায়ক ক্রোধ তাহার প্রাপ্ত হোক।
(অনুবাদঃ জয়দেব শর্মা)
=>>যজুর্বেদ ১৩।৫০
হে রাজন! তুমি পরম সর্বোচ্চ “ব্যোম” অর্থাৎ বিবিধ প্রাণীদের রক্ষাধিকারে
নিযুক্ত হয়ে সর্ব জগতের রচয়িতা পরমেশ্বর কে প্রজাদের সবার উত্তম বা সবার
সবার আদি উৎপাদক কারণ, মেঘের সমান সুখের উৎপাদক, বরুন অর্থাৎ বরণ করার
যোগ্য সুখের মূল কারণ দ্বিপদী এবং চতুষ্পদী পশুদের মধ্যে শরীরকে লোম আদি
দ্বারা আবৃতযুক্ত এই ” ঊর্নায়ু ” উল প্রদানকারী মেষ আদি জীবকে মেরো না।
তোমাকে আমি বন্য উট এর উপদেশ করি। উহা দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে শরীরের সুখকে
প্রাপ্ত করো। তোমার পীড়াজনক প্রবৃত্তি, দাহকারী পীড়দায়ক জীবের প্রাপ্ত
হোক।এবং তোমার দুঃখদায়ী ক্রোধ তাহার প্রাপ্ত যাদের আমরা দ্বেষ করি।
(অনুবাদঃ জয়দেব শর্মা)
উপরিউক্ত মন্ত্রগুলি দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, বেদ কোন নির্দোষ পশু কে হত্যার উপদেশ করে নি।বরং উপদেশ করেছে, পশুস্ত্রাঁয়েথাঙ (যজুর্বেদ ৬।১১) অর্থাৎ পশুদের রক্ষা করো এবং তাদের বর্ধিত করো।কারন বেদ সর্বদাই কল্যাণময়।
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।