শ্রীবিষ্ণুর সপ্তম অবতার হলেন শ্রীরামচন্দ্র। হিন্দুরা শ্রীরামচন্দ্রকে বলেন ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’। যিনি পুরুষশ্রেষ্ঠ, যিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি, যিনি গুণাধীশ। হিন্দুধর্মের অনেক সম্প্রদায় শ্রীরামচন্দ্রকে তাঁদের ‘সর্বোচ্চ ঈশ্বর’ হিসেবে পূজা করে থাকেন। শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যে প্রজারা সুখে, শান্তিতে বাস করতেন। শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যে ছিল সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার। এই জন্য ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ শ্রীরামচন্দ্রের শাসনের অনুসরণে সুশাসিত রাজ্যকে ‘রামরাজ্য’ বলা হয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, রামের জন্মস্থান ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অযোধ্যা শহরে।কিন্তু দুঃখজনক হলেও ভারতে এই রাম রাজ্যের অবসান হয়েছে। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে আজ ভারতবাসী রাম মন্দির নির্মাণ করতে পারেনি। শুনতে অবাক লাগলেও বহু প্রাচীন কাল থেকে থাইল্যান্ডের রাজাদের অফিসিয়াল উপাধী রাম।সেই থাইল্যান্ডের রাজা হোক তার উপাধী হবে রাম। বহু প্রাচীন কাল থেকে রাম-১, রাম-২, রাম-৩ এভাবে চলে আসছে। শুধু এখানেই শেষ না। সেখানকার একসময়ের রাজধানীর নাম ছিল অযোধ্যা (থাই ভাষায় ‘অয়ুৎথ্য’) যা ভারতের অযোধ্যার নামে নামকরণ করা হয়।
শুধু ভারতেই নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও পরম শ্রদ্ধেয় এবং পূজনীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে আজও মানা হয় শ্রীরামচন্দ্রকে। সেই সব দেশে বিভিন্ন নাম তাঁর। ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে শ্রীরামচন্দ্রের নাম ‘রামবিজয়’, কম্বোডিয়ায় তাঁর নাম ‘ফ্রেয়াহ রাম’, লাওস ও থাইল্যান্ডে তাঁর নাম ‘ফ্রা রাম’, মালয়েশিয়াতে তাঁর নাম ‘মেগাত সেরি রাম’, ফিলিপাইনসে শ্রীরাম পূজিত হন ‘রাকা বানতুগান’ নামে।
সে দেশের সমাজজীবনে মিশে আছেন রাম, রামায়ন,অযোধ্যা!
কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন ভারত থেকে অনেক দূরে থাকা এক দেশে আছে ইউনেস্কো স্বীকৃত আর একটি নগরী, তার নামও অযোধ্যা। আজও সেখানে বংশপরাম্পরায় বাস করে আসছেন ‘রাম’ উপাধিধারী এক রাজবংশ। হ্যাঁ, সে দেশে যেই রাজা হোক তার উপাধি থাকে রাম।আজও সে দেশের জাতীয় গ্রন্থ হলো রামায়ণ। হ্যাঁ, বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষের থাইল্যান্ডে আজও রাজত্ব চালাচ্ছেন আর এক ‘রাম’। তবে তিনি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নন। তাঁর উপাধি ‘রাম’। পরবর্তীকালে যিনি থাইল্যান্ডের রাজার সিংহাসনে বসবেন তিনিও ‘রাম’ উপাধি নিয়েই সিংহাসনে বসবেন।
![]() |
থাইল্যান্ডের রাজা মহা ভজীরালঙ্গকর্ণ (দশম-রাম) রাজকীয় অভিবাদন গ্রহণ করছেন |
চক্রী রাজবংশের এই ‘রাম’ রাজাদের রাজধানীর নামও অযোধ্যা। থাইল্যান্ডের মানুষ বলেন ‘অয়ুৎথ্য’। বৌদ্ধধর্মানুসারে বোধিসত্ত্ব একবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্ররূপে। জাতকের কাহিনিতে তাই রামচন্দ্রের উল্লেখ আছে। বৌদ্ধধর্মে রামচন্দ্রকে পরম ধার্মিক এবং আদর্শ নৃপতি বলা হয়েছে। তাই, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও থাইল্যান্ডের মানুষ, ‘রাম’ উপাধিধারী রাজাকে রামের বংশধর এবং বিষ্ণুর অবতার হিসাবে শ্রদ্ধা ভক্তি করেন।
কীভাবে চক্রী রাজাদের উপাধি হয়েছিল ‘রাম’!
রাজা বুদ্ধ য়োতফা চুলালোক ১৭৮২ সালে নিজের উপাধি নিজেই রেখেছিলেন ‘রাম’। রাজা চুলালোকই ছিলেন চক্রী রাজবংশের মধ্যে প্রথম ‘রাম’ উপাধিধারী রাজা। রামভক্ত এই রাজা তাঁর রাজত্বে রামায়ণের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন রাজা বুদ্ধ য়োতফা চুলালোক। যে রামায়ণ, ‘রামাকিয়েন’ নামে আজও থাইল্যান্ডে সুপরিচিত।
সেই থেকে আজ অবধি, ২৩৮ বছর ধরে, থাইল্যান্ডের চক্রী বংশীয় বৌদ্ধ রাজারা আজও ‘রাম’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন৷ আজ থাইল্যান্ডে রাজত্ব করছেন, ‘দশম-রাম’ উপাধিধারী রাজা মহা ভজীরালঙ্গকর্ণ। যিনি তাঁর পিতা রাজা ভূমিবল বা নবম- রামের মৃত্যুর পর ৬৩ বছর বয়েসে সিংহাসনে বসেছিলেন। ১ ডিসেম্বর, ২০১৭ সালে।
কীভাবে চক্রী রাজাদের উপাধি হয়েছিল ‘রাম’!
![]() |
থাইল্যান্ডের রাজা ফরাফউতথ্যৎফা চুলালক (Phraphutthayotfa Chulalok) বলা হয় প্রথম রাম। |
থাইল্যান্ডের রাজা ফরাফউতথ্যৎফা চুলালক (Phraphutthayotfa Chulalok) বলা হয় প্রথম রাম। তিনি ২১সে মার্চ ১৭৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭২ বছর বয়সে ১৮০৯ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার রাজধানী ছিল অযোধ্যা।
রাজা বুদ্ধ য়োতফা চুলালোক ১৭৮২ সালে নিজের উপাধি নিজেই রেখেছিলেন ‘রাম’। রাজা চুলালোকই ছিলেন চক্রী রাজবংশের মধ্যে প্রথম ‘রাম’ উপাধিধারী রাজা। রামভক্ত এই রাজা তাঁর রাজত্বে রামায়ণের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন রাজা বুদ্ধ য়োতফা চুলালোক। যে রামায়ণ, ‘রামাকিয়েন’ নামে আজও থাইল্যান্ডে সুপরিচিত।সেই থেকে আজ অবধি, ২৩৮ বছর ধরে, থাইল্যান্ডের চক্রী বংশীয় বৌদ্ধ রাজারা আজও ‘রাম’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন৷ আজ থাইল্যান্ডে রাজত্ব করছেন, ‘দশম-রাম’ উপাধিধারী রাজা মহা ভজীরালঙ্গকর্ণ। যিনি তাঁর পিতা রাজা ভূমিবল বা নবম- রামের মৃত্যুর পর ৬৩ বছর বয়েসে সিংহাসনে বসেছিলেন। ১ ডিসেম্বর, ২০১৭ সালে।
সিয়াম-এর রাজধানী ‘অয়ুৎথ্য’
থাইল্যান্ডের প্রাচীন নাম ছিল সিয়াম। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত থাইল্যান্ড বা সিয়ামের রাজধানী ছিলো অযোধ্যা বা অয়ুৎথ্য। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্কক থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আর এক অযোধ্যা। স্থানীয়রা বলেন ‘অয়ুৎথ্য’। সম্ভবত ১২৮৫ খ্রিস্টাব্দের আগে এই অযোধ্যা নগরীর পত্তন হয়েছিল। ব্যাঙ্ককের রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালায় রাখা ১২৮৫ সালের এক শিলালিপি তার প্রমাণ বহন করে চলেছে। সেই শিলালিপিতে রামের জীবনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ঘটনাবলী নিঁখুতভাবে বর্ণনা করা আছে।
১৭৮০ সালে, বার্মার সেনা থাইল্যান্ড আক্রমণ করে ধ্বংস করে দিয়েছিল ‘অযোধ্যা’ বা ‘অয়ুৎথ্য’ নগরী। রাজধানী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর চক্রী রাজবংশের তখনকার রাজা বুদ্ধ য়োতফা চুলালোক, থাইল্যান্ডের রাজধানী ‘অযোধ্যা’ বা ‘অয়ুৎথ্য’ থেকে সরিয়ে এনেছিলেন বর্তমানের ব্যাংককে। এখনও পর্যন্ত থাইল্যান্ডের সিংহাসনে বসেছেন ‘রাম’ উপাধিধারী দশজন রাজা। তাঁরা সকলেই চক্রী রাজবংশের রাজধানী অয়ুৎথ্য’তেই বসবাস করে এসেছেন বা আগামী দিনেও করবেন।
![]() |
একসময়ের থাই রাজধানী অযোধ্যায় রাম মন্দির |
ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ হল শ্রীরামচন্দ্র সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনীর একমাত্র উৎস। ভারতের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার বছর ধরে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পাঠ করা হয়ে আসছে রামায়ণ। তবে স্থানীয় মানুষদের কাছে সহজে পৌঁছনোর জন্য, বিভিন্ন দেশে মহাকাব্যটিতে কিছু ভাষাগত ও পরিবেশগত পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু রামায়নের মূল চরিত্রগুলি ও ঘটনা পরম্পরা কিন্তু একই আছে। বিভিন্ন দেশে রামায়ণের নাম দেশের প্রয়োজনে পালটে গিয়েছে। যেমন ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে রামায়ণকে বলা হয় ‘কাকাউইন রামায়ণ’, বালিতে ‘রামকবচ’, মালয়েশিয়য় ‘হিকায়ত সেরি রাম’, ফিলিপিনসে ‘মারাদিয়া লাওয়ানা’, কম্বোডিয়ার ‘রেয়ামকের’, মায়ানমারে ‘ইয়ামা জাতদাও’।
একইভাবে থাইল্যান্ডে রামায়ণকে বলা হয় ‘রামাকিয়েন’। যার অর্থ হলো রাম-কীর্তি। যে দেশের ৯৫% মানুষ বৌদ্ধ, সেই থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থের নাম আজও রামায়ণ বা রামাকিয়েন। থাইল্যান্ডের ‘রাম’ রাজাদের অনেক আগে, ১৩ শতাব্দী থেকে ১৫ শতাব্দী মধ্যে এই ‘রামকিয়েন’ লেখা হয়েছিল। থাইল্যান্ডের লোককথায় এবং লোকশিল্পে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল রামায়ণ। খোদ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আজও থাইল্যান্ডে নিয়মিত মঞ্চস্থ হয় ‘রামকিয়েন’ পালা ও পুতুল নাচ।থাইল্যান্ডের রামায়ণ বা রামকিয়েনের প্রধান চরিত্রগুলি হলো- রাম (রাম), সীদা (সীতা), লক (লক্ষণ), থোতসরোত (দশরথ), থর্মন (রাবণ), হানুমান (হনুমান) পালী (বালী), সুক্রীব (সুগ্রীব), ওঙ্কোট (অঙ্গদ), খোম্পুন (জাম্ববান), বিপেক (বিভীষণ), সথায়ু (জটায়ু), সূপন মচ্ছা (সূর্পনখা), মারিত (মারিচ), ইন্দ্রচিত (ইন্দ্রজিত), ফ্র প্রাই (পবনদেব ), ফরজূ (সরজূ নদী)।
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, আজও কিন্তু থাইল্যান্ড সাংবিধানিক ভাবে ঘোষিত ‘রামরাজ্য’। শ্রীরামচন্দ্র সংক্রান্ত সমস্ত লিপি ও পুঁথি, অয়ুৎথ্য(অযোধ্যা) সম্পর্কিত সমস্ত প্রাচীন প্রাসাদ, মন্দির ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সরকারি সম্পত্তি হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। আজও এভাবেই থাইল্যান্ডের সমাজজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছেন শ্রীবিষ্ণুর সপ্তম অবতার মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপেডিয়া, রূপাঞ্জন গোস্বামী (The Wall), Reuters
No comments:
Post a Comment
পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।