নোয়াখালী গণহত্যা – (২) - UHC বাংলা

UHC বাংলা

...মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী একটি গ্লোবাল বাংলা প্লাটফর্ম!

ব্রেকিং নিউজ

Home Top Ad

Thursday, May 14, 2020

নোয়াখালী গণহত্যা – (২)

ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে নোয়াখালী গণহত্যা। আজ দ্বিতীয় পর্ব। 
নোয়াখালী গণহত্যা


১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস ; ১৬ই আগষ্ট কলিকাতা সহরে মুসলীম লীগ যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আরম্ভ করিয়াছিল তাহার জের তখনও পূরা মাত্রায় চলিতেছে ; কলিকাতা মহানগরী বিপর্যস্ত ; লোকের জীবনযাত্রা বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ; ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রকোপ কলিকাতা অতিক্রম করিয়া পূর্ববঙ্গে ছড়াইয়া পড়িয়াছে ; পূর্ববঙ্গের মফঃস্বল হইতে হিন্দুনিগ্রহের নিত্য নূতন সংবাদ আসিতেছে ; কলিকাতায় অনুষ্ঠিত ঘটনার জন্য সুরাবর্দী-মন্ত্রিমণ্ডলকে ধিকৃত করিয়া ২৯শে সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব উঠিয়াছে এবং তাহার উত্তরে বলা হইয়াছে যে মন্ত্রিমণ্ডলকে অপদস্থ করিবার এই চেষ্টার ফল পূর্ববঙ্গের হিন্দুদিগকে ভোগ করিতে হইবে [অনাস্থা-প্রস্তাবের আলোচনায় লীগ-মন্ত্রী মৌলবী সামসুদ্দীনের বক্তৃতা ; পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত রিপোর্টারদের নিকট জানা যায় লীগদলভুক্ত অপর একজন বিশিষ্ট সদস্য নোয়াখালির নাম করিয়াই সতর্ক করিয়াছিলেন]। বস্তুতঃ বক্তৃতায় ভীতিপ্রদর্শনছলে যাহা বলা হইয়াছিল পূর্ববঙ্গে তখন তাহা কাৰ্যতঃ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। ২০শে সেপ্টেম্বর প্রকাশ, পূর্ববঙ্গের উপদ্রব দমনের জন্য থানায় থানায় মিলিটারী বসাইবার প্রয়োজনীয়তা দেখাইয়া নারায়ণগঞ্জ হইতে শ্রীআনন্দমোহন পোদ্দার বাঙলার গভর্ণরের নিকট ও ভারত গভর্ণমেন্টের নিকট টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছেন এবং কুমিল্লা হইতে শ্রীকামিনী কুমার দত্ত ও শ্রীধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভারত গভর্ণমেন্টের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করিয়া জানাইয়াছেন, অবিলম্বে রক্ষাব্যবস্থা না করিলে গুরুতর অবস্থা দেখা দিবে, কারণ মুসলমান সরকারী কর্মচারীরা প্রকাশ্যেই হিন্দুদিগকে ভীতি প্রদর্শন করিতেছেন। বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে নোয়াখালির প্রতিনিধি শ্ৰীহারাণচন্দ্র ঘোষ চৌধুরী ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখের আলোচনায় জেলার অবস্থার প্রতি গভর্ণমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে বলিয়াছেন এবং জেলার নানা স্থানে অনুষ্ঠিত অত্যাচারের দীর্ঘ তালিকা সংবাদপত্রে প্রকাশ করিতেছেন [অমৃতবাজার পত্রিকা ২৩/৯/৪৬ এবং হিন্দুস্থান ষ্টান্ডার্ড ২৪/৯/৪৬। ইহাই বর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৮/৯/৪৬ তারিখে।]। ইহা ছাড়া অন্যান্য বিবৃতিতেও অবস্থার প্রতিকারের জন্য গবর্ণমেন্টের নিকট পুনঃ পুনঃ দাবী করা হইয়াছে। ইহার পরেই আসে ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জে হিন্দুদিগের উপর আক্রমণের সংবাদ। তাহার পর ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে ঐ জেলার কেরাণীগঞ্জ থানা হইতেও হিন্দুসমাজের উপর অধিকতর ব্যাপক আক্রমণের সংবাদ আসে এবং সর্বত্র প্রবল উদ্বেগের সৃষ্টি করে।
সংবাদ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগঃ
এই অবস্থায়, ২৬শে সেপ্টেম্বর, প্রধান মন্ত্রী মিঃ সুরাবর্দী কলিকাতার সংবাদপত্র সম্পাদকদিগকে সেক্রেটারিয়েটে একটি বিশেষ বৈঠকে আহ্বান করিলেন। সম্পাদক-বৈঠকে মিঃ সুরাবর্দী জানাইলেন যে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও সংঘর্ষ সম্পর্কিত সংবাদের প্রকাশ নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য তিনি ভারতরক্ষা আইনের বিধান অনুসারে একটা বিশেষ আদেশ জারী করিতে মনস্থ করিয়াছেন। তাঁহার অজুহাত এই যে, কলিকাতায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি-সম্পর্কিত সংবাদ যথেচ্ছ প্রকাশিত হইতেছে বলিয়াই দেশের অন্যান্যস্থানে তাহার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতেছে ; বিশেষতঃ কলিকাতার সংবাদপত্রসমুহ হিন্দুদিগের দিকে টানিয়াই সংবাদ প্রকাশ করিতেছে। বলা বাহুল্য, কলিকাতার জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রসমূহকে লক্ষ্য করিয়াই মিঃ সুরাবর্দী উক্ত মন্তব্য করেন। সংবাদ নিয়ন্ত্রণের জন্য মিঃ সুরাবর্দী যে আদেশের খসড়া রচনা করিয়াছিলেন, তাহা বৈঠকে শুনাইলেন। উহার প্রধান নির্দেশ ছিল এই যে, বাঙলা দেশে সাম্প্রদায়িক উপদ্রবসংক্রান্ত ঘটনার কোনোরূপ উল্লেখ করিতে হইলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বাদ দিতে হইবে :—
(১) ঘটনার স্থানের উল্লেখ [পরে থানার উল্লেখ অনুমোদিত হইয়াছিল।]
(২) ঘটনায় মৃত অথবা আহত ব্যক্তিদের আঘাত বা মৃত্যুর কারণের উল্লেখ
(৩) আক্রান্ত বা আক্রমণকারী ব্যক্তিদের নাম বা সম্প্রদায়ের উল্লেখ
(৪) দেবস্থান বা পূজার বস্তু অপবিত্র করার বর্ণনা
(৫) ঘটনার এবং ঘটনায় মৃত ও আহত ব্যক্তিগণের ফটো বা অন্য কোনোরূপ চিত্র।
ইহা ছাড়া আরও একটি বিষয় নিষিদ্ধ হয়, খবরের হেডিংএর হতাহতের সংখ্যার উল্লেখ। এই সমস্ত নিষেধ-বিধান কেবল সংবাদপত্রে প্রাপ্ত সংবাদের উপর প্রযোজ্য হইবে, কিন্তু গভর্ণমেন্ট স্বীয় অভিপ্রায়ানুরূপ যে কোনো সংবাদ প্রকাশ করিতে পারিবেন, তাহাতে ইহা প্রযোজ্য হইবে না। আদেশের খসড়াটি পড়িয়া মিঃ সুরাবর্দী উহার সম্বন্ধে উপস্থিত সম্পাদকগণের মতামত জানিতে চাহিলেন।
প্রত্যুত্তরে বলিলাম—“আপনার এই আদেশের বিধানসমূহ শুনিয়া। যাহা মনে হইতেছে তাহা খোলাখুলি বলিতে পারি কি ?”
মিঃ সুরাবর্দী—“কেন বলিবেন না?”
বলিলাম—“আমার মনে হইতেছে, পূর্ববঙ্গে যে সকল অত্যাচার কাণ্ড ঘটিতেছে এবং যাহা ঘটিতে যাইতেছে তাহা চাপা দিবার জন্যই আপনার এই আদেশের ব্যবস্থা।”
এই কথা শুনিয়া মিঃ সুরাবর্দী রুষ্ট হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, “আপনি একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে রহিয়াছেন, আর আপনি আমার আদেশের এই কদৰ্থ করিতেছেন?”
উত্তরে বলিলাম—“মার্জনা করিবেন। আপনার আদেশের অন্য কোনো অর্থ আমার মনে আসিতেছে না; অন্য কোনো অর্থ হয়ও না ; এখানে বাহিরের লোক নাই, অন্ততঃ এই ঘরের মধ্যে পরস্পরের মনের কথা খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করিতে দিন ”
মিঃ সুরাবর্দীর অজুহাতঃ
মিঃ সুরাবর্দী অধিকতর উত্যক্ত হইয়া উঠিতেছেন দেখিয়া বলিলাম, “আপনি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন, আপনি “বলিয়াছেন, – সংবাদপত্রে সাম্প্রদায়িক অশান্তি-সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশের প্রতিক্রিয়াতেই মফস্বলে অশান্তি দেখা দিতেছে। যে সংবাদপত্রগুলি আপনার মন্তব্যের লক্ষ্য সেগুলিতে হিন্দুর উপর মুসলমানের অত্যাচারের সংবাদটাই ফলাও করিয়া ছাপা হয়—ইহা আপনার ধারণা। সুতরাং ইহার প্রতিক্রিয়া যদি কোথাও দেখা দেয় তো পশ্চিমবঙ্গেই দেখা দেওয়া উচিত, পূর্ববঙ্গে দেখা দিতে পারে না। পূর্ববঙ্গে যাহা ঘটিতেছে তাহা যদি কিছুর প্রতিক্রিয়া হয় উহা আপনার দলীয় মুসলিম লীগ সংবাদপত্রে প্রকাশিত মুসলমানের উপর হিন্দুর অত্যাচারের কাল্পনিক সংবাদের প্রতিক্রিয়া। সুতরাং দায়ী করিতে হইলে তাহাদিগকেই দায়ী করিতে হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গে এই সকল ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে যখন কোন প্রতিক্রিয়া নাই তখন জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রসমূহকে দায়ী করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই।” তথ্য ও যুক্তি দিয়া ইহা খণ্ডন করিবার উপায় ছিল না। মিঃ সুরাবর্দী কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন “পশ্চিমবঙ্গেও এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে বলিয়া আমি সংবাদ পাইয়াছি।”
উত্তরে বলিলাম, “আপনি একটি প্রকাশিত ঘটনার বিবরণ দেখান ; পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানের উপর কোন অত্যাচার হইলে আপনার দলীয় সংবাদপত্রসমূহ কখনই তাহা প্রকাশ করিতে ছাড়িত না।”
মিঃ সুরাবর্দী—“প্রকাশিত হয় নাই বটে কিন্তু স্থানীয় লোকেরা আমাকে খবর দিয়া গিয়াছে।”
হোম সেক্রেটারী মিঃ মার্টিন প্রধান মন্ত্রীর পার্শ্বে বসিয়াছিলেন, তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “কেমন মিঃ মার্টিন আপনিও কি এইরূপ খবর পান নাই ?”, মিঃ মার্টিন বলিলেন “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও এইরূপ খবর পাইয়াছি বটে।”
মিঃ মার্টিনকে লক্ষ্য করিয়া বলিলাম –“মিঃ মার্টিন, আপনার ডিপার্টমেন্ট এইরূপ ঘটনার কোন রিপোর্ট আসিয়াছে কি ?”
তিনি বলিলেন—“না, তবে, লোকে আমাকে বলিয়া গিয়াছে।”
উত্তর বলিলাম—“মিঃ মার্টিন, আপনার হাতে কোন রিপোর্ট নাই, তত্ৰাচ যদি আপনি বলেন যে পশ্চিমবঙ্গে এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে তাহা হইলে আমি বলি আপনি যে পদ অধিকার করিয়া আছেন তাহার যোগ্যতা আপনার নাই।”
প্রেস এডভাইসরী কমিটি উপেক্ষিতও আদেশ জারীঃ
এইভাবে কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর মিঃ সুরাবর্দী ও সিভিলিয়ানবর্গ হয়তো আপনাদের আচরণের অসঙ্গতি উপলব্ধি করিলেন এবং আদেশটা সদ্য সদ্য জারী করিরার উদ্যোগ স্থগিত রাখিতে সম্মত হইলেন। সম্পাদকগণের দিক হইতে প্রস্তাব হইল গভর্ণমেন্ট এইরূপ আদেশ জারী না করিয়া বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির উপর এই শ্রেণীর সংবাদ নিয়ন্ত্রণের ভার অর্পণ করিয়া নিরস্ত থাকুন। গত মহাযুদ্ধের সময় গভর্ণমেন্ট বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির সাহায্য লইয়াছেন। বর্তমান অবস্থাতেও সেই ব্যবস্থাই পুনরায় প্রবর্তিত হইতে পারে। উভয় পক্ষের এই কথাবার্তার পর আলোচনা চারদিনের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত করা হইল। স্থির হইল ৩০শে সেপ্টেম্বর, সোমবার পুনরায় সম্পাদকগণের সহিত মিলিত হইয়া মিঃ সুরাবর্দী এবিষয়ে সিদ্ধান্ত করিবেন। ইতিমধ্যে সম্পাদকগণ পরামর্শ করিয়া দেখিবেন প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটিকে দিয়া কি ভাবে সংবাদ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হইতে পারে।
এই কথাবার্তা অনুসারে ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে “ষ্টেটসম্যান” পত্রিকার অফিসে বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির আহ্বানে সম্পাদকগণের এক সভা হয় এবং সাম্প্রদায়িক উপদ্রবের সংবাদ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সাব-কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মিঃ সুরাবর্দীর নিকট প্রেরণের সঙ্গে সঙ্গেই মিঃ সুরাবর্দীর পক্ষ হইতে একটি জরুরী পত্ৰ আসে, ঐ পত্রে জানানো হয় যে, গভর্ণমেণ্ট পূর্ব প্রস্তাবমত ৩০শে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করিবেন না, সেই দিনই সিদ্ধান্ত করিতে মনস্থ করিয়াছেন এবং তজ্জন্য সম্পাদকদিগের এক জরুরী বৈঠক আহুত হইয়াছে। গভর্ণমেন্টপক্ষের এই মতিপরিবর্তনে বিস্মিত হইয়া সম্পাদকগণ সেক্রেটারিয়েটের বৈঠকে উপস্থিত হইলেন। মিঃ সুরাবর্দী জানাইলেন, তিনি আর অপেক্ষা করিতে পারিবেন না; আদেশ সদ্যই জারী হইবে; বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির উপর সমস্ত ভার ছাড়িয়া দেওয়ার যে প্রস্তাব হইয়াছিল গভর্নমেন্ট তাহাতে সম্মত নহেন, তবে কমিটিকে সুযোগ দিবার জন্য গভর্ণমেন্ট এইটুকু করিতে রাজী আছেন যে, কমিটির অনুমোদিত সংবাদও গভর্ণমেন্টের অনুমোদিত সংবাদের ন্যায় প্রকাশিত হইতে পারিবে, নূতন আদেশের মধ্যে এই ব্যবস্থা থাকিবে [ব্যবস্থাটি এইঃ-“Provided that nothing in this order shall apply to any matter communicated by the Provincial Government to the Press or any communication issued to the Press by the Press Advisory Committee, Bengal.”] ।
এই ব্যবহারে, বিশেষতঃ প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির অনুমোদিত সংবাদকে সরকারী বিবৃতির সমপৰ্যায়ভুক্ত করায় সকলেই অত্যন্ত বিরক্ত হন। আলোচনাপ্রসঙ্গে মিঃ সুরাবর্দীকে জিজ্ঞাসা করি, “আপনি সকলের অনুরোধ অগ্রাহ্য করিয়া সহসা এই আদেশ জারী করিতেছেন। এই আদেশ জারীর কতদিনের মধ্যে আপনি অশান্তি প্রশমিত করিতে পারিবেন বলিয়া মনে করেন ?”
মিঃ সুরাবর্দী বলিলেন, “এই আদেশ যদি জারী হইতে পারে তাহা হইলে তিন দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনিতে পারিব।” এই আদেশই ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখে ভারতরক্ষা আইনের বিধানানুযায়ী বিশেষ আদেশরূপে জারী হয়।
সংবাদপত্রের প্রতিবাদঃ
মিঃ সুরাবর্দীর এই হঠকারী উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইবার জন্য ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখেই অমৃতবাজার পত্রিকার সিটি অফিসে সংবাদপত্রের সম্পাদক ও পরিচালকদিগের এক সভা হয়। সভায় স্থির হয় যে, সংবাদপত্রসমূহের প্রকাশ স্থগিত রাখাই প্রতিবাদ জ্ঞাপনের সুষ্ঠু উপায়। ১লা অক্টোবর হইতে প্রকাশ স্থগিত রাখিবার জন্য সকল সংবাদপত্রকে অনুরোধ জানাইয়া এক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং গত কয়েকদিনের যে সকল ঘটনার ফলে সভা এই প্রস্তাব গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন সভার পক্ষ হইতে চারিজনের স্বাক্ষরে এক বিবৃতি প্রকাশ করিয়া তাহা সকলকে জানানো হয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর তারিখের সংবাদপত্রে একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় সরকারী নিয়ন্ত্ৰণাদেশ এবং তাহার প্রতিবাদে সংবাদপত্র-প্রতিনিধিদিগের সিদ্ধান্ত ও বিবৃতি। প্রত্যুত্তরে মিঃ সুরাবর্দী ১লা অক্টোবর তারিখের এক বিবৃতি প্রকাশ করিয়া জানান যে, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করিবার বা প্রকৃত ঘটনা চাপা দিবার ইচ্ছা তাহার নাই। ১লা অক্টোবর তারিখে পুনরায় সংবাদপত্র প্রতিনিধিগণের এক সভায় মিঃ সুরাবর্দীর এই বিবৃতি বিবেচিত হয় এবং গভর্ণমেন্টকে পুনরায় অনুরোধ করা হয় যে তাহারা আদেশ প্রত্যাহার করিয়া বিরুদ্ধ-ভাবমুক্ত অবস্থার মধ্যে প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটিকে কাজ করিতে দিন। সভার পক্ষ হইতে চারিজনের স্বাক্ষরে এক বিবৃতি প্রকাশ করিয়া সভার এই সিদ্ধান্ত এবং মিঃ সুরাবর্দীর প্রত্যুত্তরে সভার বক্তব্য বিজ্ঞাপিত করা হয়। বলা বাহুল্য, গভর্ণমেন্ট ইহার প্রতি কোনো সুবিবেচনা করেন নাই; ফলে ১লা অক্টোবর হইতে কলিকাতায় জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রসমূহের প্রকাশ বন্ধ হইয়া যায়।
ন্যূনপক্ষে ২১ খানি পত্রিকার [আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্থান ষ্টাণ্ডার্ড, দেশ, অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, বসুমতী, ভারত ইষ্টার্ণ এক্সপ্রেস, কৃষক, মাতৃভূমি, এ্যাডভ্যান্স, বিশ্বমিত্র, লোকমান্য, জাগৃতি, জয়হিন্দ, প্রত্যহ, ন্যাশনালিষ্ট, উষা, নবযুগ, স্বাধীনতা, দেশদর্পণ।] প্রকাশ স্থগিত থাকে। ইতিমধ্যে ঘটনার গতি দ্রুতবেগে অগ্রসর হয় এবং নূতন ঘটনার উদ্ভব হইতে থাকে। কয়েকদিন এইরূপ চলিলে লোকের মধ্যে দারুণ উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। তাহার ফলে সংবাদপত্রের সম্পাদক ও পরিচালকগণ পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের জন্য জনসাধারণের পক্ষ হইতে বিশেষভাবে অনুরুদ্ধ হন। ৬ই অক্টোবর পুনরায় তাঁহারা এক সভায় সমবেত হইয়া পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত করেন। স্থির হয়, সরকারী নিয়ন্ত্ৰণাদেশে প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে তাহা কাৰ্যতঃ পরীক্ষা করিয়া দেখতে হইবে।
নোয়াখালির উপদ্রবের সংবাদঃ
এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ৮ই অক্টোবর হইতে পত্রিকাসমূহ পুনরায় প্রকাশলাভ করে এবং প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির পক্ষ হইতে সাম্প্রদায়িক উপদ্রবঘটিত সংবাদের সংগ্রহ, সম্পাদন ও প্রচারের ব্যবস্থা হয়। ইহার প্রায় অব্যবহিত পরেই নোয়াখালির ঘটনা ; ১০ই অক্টোবর ঘটনা আরম্ভ হয় এবং ১১ই অক্টোবর হইতেই কলিকাতায় লোকমুখে প্রচারিত হইতে থাকে যে, নোয়াখালিতে প্রবল ও ব্যাপক আকারে অরাজকতা দেখা দিয়াছে এবং তথাকার হিন্দুসমাজের উপর ভয়াবহ অত্যাচার সংঘটিত হইয়াছে। তৎকালে সাম্প্রদায়িক উপদ্রবের অন্যান্য সকল সংবাদকে অতিক্রম করিয়া নোয়াখালির ঘটনার সংবাদ যে উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চিত আতঙ্ক সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা বিস্মৃত হইবার নহে। কিন্তু ১৪ই অক্টোবর পর্যন্ত নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট সংবাদ কিছু পাওয়া যায় নাই। ১৪ই অক্টোবর প্রথম সংবাদ আসে ; যতদূর মনে হইতেছে প্রথম সংবাদের প্রেরক নোয়াখালি মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র রায় চৌধুরী এবং পাইকপাড়া জমিদারীর অন্তভুক্ত স্থানীয় ভুলুয়া ষ্টেটের ম্যানেজার শ্রীপ্রফুল্ল কুমার ভৌমিক। তাহাদের এই টেলিগ্রাম দিল্লীতে তৎকালীন ভারত, গভর্ণমেন্টের সদস্য শ্রীশরৎচন্দ্র বসুর নিকটেও প্রেরিত হইয়াছিল। ১৪ই তারিখে প্রাপ্ত সংবাদ প্রেস এ্যাডভাইসরী কমিটির অনুমোদন ক্রমে ১৫ই তারিখের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। নোয়াখালি-ত্রিপুরার ধ্বংসকাণ্ড সম্বন্ধে কলিকাতায় সংবাদ প্রকাশ এই প্রথম। সংবাদটি এইঃ –
“নোয়াখালি জেলায় সঙ্ঘবদ্ধভাবে গুণ্ডামীর সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। উত্তেজিত জনতা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র লইয়া বিভিন্ন গ্রামে হানা দিতেছে এবং গত ১০ই অক্টোবর বৃহস্পতিবার হইতে ব্যাপকভাবে খুন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চলিতেছে। বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা, নারীহরণ এবং ধৰ্ম্মস্থান অপবিত্র করার সংবাদও পাওয়া গিয়াছে। এপর্যন্ত যে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে তাহাতে জানা যায় যে, সদর ও ফেণী মহকুমার দুইশতাধিক বর্গমাইল পরিমিত স্থানে হাঙ্গামা চলিতেছে। উপদ্রুত অঞ্চলের প্রবেশপথসমূহে সশস্ত্র গুণ্ডাগণ পাহারা দিতেছে। বহুলোক নিহত অথবা জীবন্ত দগ্ধ হইয়াছেন— তাহাদের মধ্যে জেলা উকীল-সভার সভাপতি ও তাহার পরিবারবর্গ এবং জেলার একজন বিশিষ্ট জমিদারও আছেন।
কলিকাতার সরকারী মহলে সংবাদ লইয়া জানা গেল যে, উপদ্রুত অঞ্চলে সৈন্য ও সশস্ত্র পুলিশ প্রেরণ করা হইয়াছে। সমগ্র রামগঞ্জ থানা এবং লক্ষ্মীপুর থানা, রায়পুর থানা, সেনবাগ থানা, ফেণী থানা, ছাগলনাইয়া থানা, সন্দ্বীপ থানা ও বেগমগঞ্জ থানার কিয়দংশ উপদ্রুত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।”(ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment

পোস্টটি ভালো লাগলে কমেন্ট করুন। আপনার কোন তথ্য সংরক্ষণ বা প্রকাশ করা হবে না। আপনি Anonymous বা পরিচয় গোপন করেও কমেন্ট করতে পারেন।

অন্যান্য

Post Bottom Ad

আকর্ষণীয় পোস্ট

code-box